কৌশলেই সফল খামারি হয়েছেন প্রবাস ফেরত বাবলু রহমান (৪৫)। টাকার অভাবে অষ্টম শ্রেণীতেই পড়াশোনার ইতি টানতে হয় তাঁকে। ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ মেটাতে পাড়ি জমান সৌদি আরব।
দীর্ঘ ১০ বছর কঠোর পরিশ্রম করে ফেরেন দেশের মাটিতে। টাকা নিয়ে তো আর বসে থাকা যায় না। শুরু করলেন ৩’শ মুরগি দিয়ে খামার। শুরুতেই ব্রয়লার মুরগি থাকলেও এখন তাঁর খামারে ৫ হাজার সোনালী মুরগি। বর্তমান সোনালী মুরগির বাজারদর অনুযায়ী লাভ আশা করছেন দুই লাখ টাকা।
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার রাইগাঁ ইউনিয়নের কুড়াইল সরদারপাড়া গ্রামে দেড় একর জায়গায় বাবলুর বাড়ি ও খামার। জমির উত্তর ও দক্ষিণে দুটি সোনালী মুরগির খামার। খামারের পাশে পুুকুর, ধানী জমি। তার পাশে রয়েছে বায়োগ্যাস প্লান্ট।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তার খামারে গিয়ে দেখা যায় ৬ বছর বয়সী বড় ছেলে আব্দুলাহকে সাথে নিয়ে মুরগিকে খাবার দিচ্ছেন। ৪৪ ফুট দীর্ঘ ও ৩৪ ফুট প্রস্থের টিনের ছাউনির ঘর তারজালি দিয়ে ঘেরা। ১০০ গজ দুরেই পুকুর পাড়ে আরেকটি খামার। উঠানে বাঁধা রয়েছে ৪টি বড় গরু। খামারে মোটা অঙ্কের লাভ আসলে তিনি কিনে ফেলেন একটা গরু। এটি টাকা বাড়ানোর একটা কৌশল!
বাবলু বলেন, ২০০৩ সালে অভাব অনটনের কারণে বিদেশে যাই। সেখান থেকে ২০১৪ সালে দেশে ফিরে পোল্ট্রি পালনের দিকে নজর দিই। এখন দুই ভাই আলাদা। তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমি এই দুই খামার দেখাশুনা করে আর কৃষি জমিতে কাজ করেই সময় কাটাই। টাকার অভাবে একসময় পড়াশোনা হয়নি। কিন্তু এখন আমার মোটামুটি চলে। বাবা-মাকেসহ নিজে হজ্ব করেছি। ১৬ বিঘার মতো জমি হয়েছে। আমি এখন সুখী।
কোন সরকারি প্রশিক্ষন নিই নি। তবে, ২০০০ সালের দিকে ব্রাকের এক কর্মকর্তার কাছে মুরগি পালন সম্পর্কে জেনেছিলাম। এখন নিজে ব্যবসায় জড়িত হওয়ায় অভিজ্ঞতা দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। ৫ হাজার সোনালী মুরগি পালন করতে লাখ ছয়েক টাকা লাগে। বছরে ৩ চালান মুরগি বিক্রি করলে সংসারের সকল খরচ উঠে আসে। ২০০ টাকা কেজির বেশি মুরগি বিক্রি করলে হাজারে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়। এবার করোনার কারণে কোন লাভ করতে পারিনি। আশা করছি এখন যে দাম আছে সে দামে লাভ আসবে দেড় লাখ টাকার মতো।
আমার আশেপাশে অনেকে মুরগির ব্যবসাতে লোকসান খেয়েছেন। ডিলারের কাছে জিম্মি থেকে ব্যবসা করছেন। আমি সব নগদ কিনে খামার পরিচালনা করছি। নগদ কিনলে প্রতি খাদ্যের বস্তাতে ১০০ টাকা কম পেলে আমার ৫ হাজার মুরগি বিক্রি করা পর্যন্ত খাবার খায় ২২৫ বস্তা। প্রতি এক হাজার সোনালী মুরগি বিক্রির উপযোগী হতে হতে খাবার খায় ৪০-৪৫ বস্তা। মুরগির গড় ওজন হয় ৮’শ থেকে ৯’শ গ্রাম। তাহলে প্রায় ২০ হাজার টাকা আমার খাদ্যতেই লাভ হচ্ছে। ঔষুধেও একই কাহীনি। খামার লাভজনক করতে নগদ ব্যবসা করা দরকার। কিছু কৌশল করলেই ব্যবসায় লাভ না হোক লোকসান এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
আবার অবকাঠামোগত দিক বিবেচনা করলে খামারে লাভবান হওয়া যায়। স্টিলের টিন মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আমার খামারে সিমেন্ট শীট লাগাব। শুনেছি, আনোয়ার সিমেন্ট শীট খুবই ভালো, মজবুত। টিকে বেশিদিন। আমার এক ভাস্তে লাগিয়েছে। আমিও খামার বাড়ানোর চিন্তা করছি। সেই খামারে পুরোটাই আনোয়ার সিমেন্ট শীট লাগাব। সিমেন্ট শীটে শীতের সময় পাল্লা ( শিশির পড়ে না। আবার গরমের সময় বেশি গরম হয় না। বেশিদিন টিকলে খামার লাভের দিকেই যাবে।
বড় ছেলে আব্দুল্লাহ (৬) ছোট ছেলে আব্দুর রহমানকে (৩) মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান এই খামারি। তিনি বলেন, মুরগির ব্যবসা করা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। প্রান্তিক খামারিরা একবারের বেশি লোকসান খেলে আর দাঁড়াতে পারেন না। সরকার তাদের সহযোগিতা করে না। আর এরকম কোন সুবিধে বাংলাদেশে নেই। জমি-জমা বিক্রি করে দেউলিয়া হতে হয়। পরিবারের সদস্যদের অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হয়।
তবে, শিক্ষিত, পরিশ্রমীরা এটা করতে পারেন। তার আগে দেশে পোল্ট্রি নীতিমালা প্রয়োজন। বাইরের দেশে আমাদের উৎপাদিত ডিম-মুরগি রপ্তানি করতে পারলে উৎসাহ বাড়তো সেইসাথে নিজেরা লাভবান-স্বাবলম্বী হতে পারত। করোনায় আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছি কিন্তু অনেকেই পারেননি। সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে করোনার আগের বছরগুলোতে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আসত। এবছর সেটা হয়নি।
উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা: মোঃ গোলাম রাব্বানী বলেন, উপজেলার রাইগাঁ ইউনিয়নে অনেক খামার রয়েছে। ডিমপাড়া লেয়ার বা ব্রয়লার মুরগি সেখানে মূলত পালন হয় না। সবগুলোই সোনালী মুরগি। প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে নিয়মিত খোঁজ খবর পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া খামারিরা মোটামুটি অভিজ্ঞ। কোন সমস্যা হয়না। আমাদের জনবল সঙ্কট রয়েছে। জনবল নিয়োগ হলে কাজের আরো গতি ফিরে আসবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২১ফেব্রুয়ারি২০২১