মােরগ-মুরগি পালনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। মুরগির সঠিক উৎপাদন পেতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নির্মাণ করতে হবে। মুরগির বাসস্থান যে এলাকায় তৈরি করা হবে, সে এলাকায় প্রাপ্ত উপকরণের উপর ভিত্তি করে পদ্ধতি গ্রহন করা উচিত। এতে নির্মাণ ব্যয় অনেক কম হবে এবং খামারিরা অতি সহজেই নির্মাণ করতে পারবেন। আমাদের দেশে খামারিরা সাধারনত ৩টি পদ্ধতিতে ডিমপাড়া মুরগি পালন করে থাকে। যথাঃ
লিটার পদ্ধতি
মাচা পদ্ধতি ও
খাঁচা পদ্ধতি।
নিন্মে প্রতিটি পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা সহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালনঃ
এই পদ্ধতিতে ঘরের মেঝের উপর বিছানা হিসাবে কাঠের গুঁড়া, তুষ, খড়ের ছােট ছােট টুকরা ইত্যাদি ব্যবহার করে মুরগি পালন করা যায়। লিটারের সহজলভ্যতা ও দামের উপর নির্নয় করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম লিটার ব্যবহার করা হয়। তবে বেশিরভাগ স্থানে ধানের তুষ ব্যবহার করা হয়।
লিটার পদ্ধতি আবার দুই প্রকার :
(ক) লিটার পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে ঘরের মেঝেতে ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে লিটার বিছানো থাকে।
(খ) ডিপ লিটার পদ্ধতি: ঘরের মেঝেতে পুরু বা মােটা করে লিটার দেওয়া হয়। সাধারণত ৪-৮ ইঞ্চি,পুরু করে লিটার দেওয়া হয়।
লিটার পদ্ধতিতে বাচ্চা মুরগির জন্য ২-৩ ইঞ্চি, বাড়ন্ত মুরগির জন্য ৩-৪ ইঞ্চি ও ডিম উৎপাদনকারী মুরগির জন্য ৪-৮ ইঞ্চি পুরু করা উচিত। মুরগি ঘরে উঠানাের ১ সপ্তাহে পূর্বে লিটার সরবরাহ করতে হবে।
মুরগির-লিটার
লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালন
লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালনের সুবিধা :
নির্মাণ ব্যয় কম।
লিটার ব্যবহার করলে মুরগির পায়খানা ঘরের মেঝের সাথে লেপ্টে থাকে না।
ঘর শুকনা ও দুর্গন্ধমুক্ত থাকে।
ঘরে মুরগির অবস্থানকাল পর্যন্ত পরিষ্কার করতে হয় না।
ডিম পাড়া শেষে বাতিল মুরগি বিক্রির পর লিটার পরিষ্কার করতে হয় ।
ডিমের গুণগুণ ভালাে হয় ও ডিম কম ভাঙে।
ডিম উৎপাদন বেশি হয়।
মুরগির স্বাস্থ্য ভালাে থাকে।
মুরগি বেশি আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করে।
তুলনামূলক সহজ ব্যবস্থাপনা।
লিটারের মধ্যে একপ্রকার ভিটামিন ও আমিষ তৈরি হয় যা মুরগি লিটার থেকে খুঁটে খায়। •
লিটার জৈব সার হিসাবে জমিতে ব্যবহার করা যায় এবং জৈব খাদ্য হিসাবে মাছের জন্য ব্যবহার
করা যায়।
লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালনের অসুবিধা :
শ্রমিক খরচ বেশি।
ডিম ময়লা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অধিক জায়গা প্রয়ােজন হয়।
রােগব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মেঝেতে ডিম পাড়ার প্রবণতা হতে পারে।
ভিজা লিটার মুরগির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
লিটারের আর্দ্রতা বেশি থাকলে অ্যামােনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয় যা মুরগির জন্য ক্ষতিকর।
মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালনঃ
ঘরের মধ্যে সমস্ত মেঝেজুড়ে মেঝের উপর ২৭ ইঞ্চি উঁচুতে মাচা তৈরি করা হয়। অনেক সময় পরিবেশ অনুসারে আরও উঁচু মাচা যুক্ত ঘর তৈরি করা হয়। মাচার ফাঁক দিয়ে মুরগির পায়খানা মাচার নিচে জমা হলে নিচে ঢুকে পরিষ্কার করতে হয়। ডিম পাড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত ঘরের নিচে পায়খানা জমা হয়। এই পদ্ধতিতে মাচার নিচে মাছির উপদ্রব হয় এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, ফলে মাঝে মাঝে বিষ্টা পরিষ্কার করে ফেলা হয়। বড় বাণিজ্যিক খামারে এ পদ্ধতি তেমন জনপ্রিয় নয়। সেখানে মাচার নিচে বাতাস প্রবাহ বাড়িয়ে পায়খানা শুকানাে ব্যবস্থা থাকে।
মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন
মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন
মাচা পদ্ধতির সুবিধা:
রােগব্যধি কম হয়।
লিটার পদ্ধতির তুলনায় বেশি মুরগি রাখা যায়।
বিছানার দরকার হয় না।
মুরগির বিষ্ঠা মাছের খাদ্য হিসেবে বেশি উপযােগী।
মাচা পদ্ধতির অসুবিধা:
নির্মাণ ব্যয় বেশি।
ডিম ভাঙার সম্ভাবনা বেশি।
প্রজননের জন্য অসুবিধা।
মুরগির বিষ্ঠা পরিষ্কার করতে অসুবিধা।
মাছির উপদ্রব বেশি।
খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালনঃ
বর্তমানে আধুনিক বিশ্বে খাঁচা পদ্ধতিতে দক্ষভাবে ডিমপাড়া মুরগি পালন করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি খাঁচার খােপের মাপ দৈঘ্য ১৮”x প্রস্থ ১২”x উচ্চতা ১৯” হলে, সেখানে অনায়াসে ৩টি ডিম পাড়া মুরগি রাখা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের খাঁচা বাজারে পাওয়া যায়।
(ক) একক ডেক খাঁচাঃ ঘরের মধ্যে একক সারিতে স্থাপন করা হয়। প্রতি খাঁচা ঘরের মধ্যে একই সমতলে থাকে। মুরগির পায়খানা সরাসরি খাঁচায় নিচে ঘরের মেঝেতে পড়ে। খাঁচা ঘরের সিলিং-এর সাথে ঝুলিয়ে বা পিলারের উপর স্থাপন করা যায়।
(খ) দুই ডেক খাঁচাঃ খাঁচা সিড়ির আকারে একটির উপর অপরটি দুই সারিতে স্থাপন করা যায়। প্রতি সারিতে খাঁচায় অবস্থিত মুরগির পায়খানা সরাসরি খাঁচার নিচে মেঝের উপর পড়ে। খােলামেলা ঘরের জন্য এই খাঁচা উপযােগী।
(গ) তিন ডেক খাঁচাঃ এই প্ৰকৃত্রি খাঁচা একটির উপর অগটি দুইভাবে সার্বিদ্ধ করে স্থাপন করা যায়। প্রথমত, সরাসরি একটি উপর অপর সারির খাঁচা স্থাপন করা যায়। প্রতি সারিতে খাঁচার নিচে মুরগির পায়খানা জমা হওয়ার জন্য ট্রে দেয়া থাকে। যা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়। দ্বিতীয়ত, তিন সারিতে পরস্পরের উপর সিঁড়ির আকারে খাঁচা সাজানাে হয়। প্রতি তলার খাঁচার মুরগির পায়খানা সরাসরি খাঁচার নিচে মেঝেতে পড়ে। লােহার আঙ্গেল দ্বারা তৈরি করে এক সারিতে সিরি আকারে প্রতিটি অবকাঠামাের উপর ২৪টি খাঁচা স্থাপন করা যায়। একটি খাঁচায় একটি মুরগি হিসাবে ২৪টি খাঁচায় ৭২টি মুরগি পালন করা যায়। অনুরূপভাবে স্থাপিত প্রচার প্রচলন বেশি। প্রতি অবকাঠামাে ৬ ফুট ৭ ফুট এবং পায়াসহ উচ্চতা ৪.৫ ফুট। এভাবে ৪ বা ৫ ডেক স্থাপন করা যায়।
(ঘ) ফ্লাট ডেক টাইপঃ একই সারিতে একই সমতলে ঘরের মধ্যে খাঁচা স্থাপন করা হয়। প্রতি সারিতে খাঁচা খুব কাছাকাছি স্থাপন করা । পরিচর্যা করার জন্য সারির মধ্যভাগে যাতায়াতের রাস্তা থাকে না। প্রতি সারির নিচ দিয়ে মটর চালিত চওড়া বেল্ট চালু থাকে। সেখানেই মুরগির পায়খানা পড়ে। এই চল বেল্ট পায়খানা টেনে ঘরে বাইরে নিয়ে যায়। ডিম সংগ্রহের জন্য চওড়া কনভেওয়র বেল্ট মটরের সাহায্যে চালু করা হয়।
(ঙ) পিরামিড টাইপ বহুতল খাঁচাঃ তিন সারিতে পরস্পরের উপর সিঁড়ির আকারে খাঁচা সাজানাে হয়। এভাবে উভয় পাশে যখন ৩ সারিতে পরস্পরের উপর সিঁড়ির আকারে খাঁচা সাজানাে হয়, তখন এতে পিরামিডের মতাে মনে হয়। প্রতি তলার খাঁচার মুরগির পায়খানা সরাসরি খাঁচার নিচে মেঝেতে পড়ে। লােহার অ্যাঙ্গেল দ্বারা তৈরি করে এক সারিতে সিড়ির আকারে প্রতি অবকাঠামাের উপর ২৪টি হিসাবে উভয় পাশে মােট ৪৮টি খাঁচা স্থাপন করা যায়। প্রতি খাঁচায় ৩টি মুরগি হিসাবে ৪৮টি খাঁচায় ১৪৪টি মুরগি পালন করা যায়।
Automatic 3 tier layer cage system
খাঁচা পদ্ধতির সুবিধা:
অল্প জায়গায় বেশি মুরগি পালন করা যায়।
পরিচর্যা ও যত্ন নেওয়া সহজ।
রােগ বিস্তারের সম্ভাবনা কম।
খাঁচার মধ্যে মুরগি কখনও কুঁচে হয় না। ডিম পাড়ার সাথে সাথে গড়িয়ে খাঁচার বাইরে চলে আসে।
মুরগির ডিম খাওয়া অভ্যাস জন্মাতে পারে না।
ডিম ময়লা হয় না।
মুরগির কৃমিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম।
বিষ্ঠা দিয়ে বায়ােগ্যাস তৈরি করা যায়।
খাঁচা পদ্ধতির অসুবিধা:
খাঁচার নিচে মুরগির পায়খানা জমে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় ও মাছির উপদ্রব হয়।
নিয়মিত পায়খানা পরিষ্কার করা বিরক্তিকর।
দুর্গন্ধে পার্শ্ববর্তী পরিবেশ দূষিত হয়।
খাঁচা তৈরিতে প্রাথমিক বিনিয়ােগ বেশি।
ডিমে রক্তজমা সৃষ্টির হার বেশি।
পায়ের নিচে খাঁচার ঘর্ষণে কড়া পড়ে। একে ‘বাম্বল ফুট’ বলে।
খাঁচায় পালিত মুরগির হাড় অত্যন্ত ভঙ্গুর হয় এবং বাতিল মুরগির দাম কম পাওয়া যায়।
মুরগির ভিটামিন বি গ্রুপের অভাব বেশি হয়।
এছাড়াও আরো বেশ কিছু মুরগি পালনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে।
পরিশেষঃ
যদি মুরগি পালনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে তবে সার্বিক ব্যবস্থাপনা, স্থায়ী খরচ ও স্বাস্থ্যসম্মত দিক বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে মাচা ও খাঁচা পদ্ধতিতে ডিমপাড়া মুরগি পালন অধিক লাভজনক।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৭এপ্রিল ২০২২