রংপুরে কমছে মাছের উৎপাদন

114

রংপুর জেলায় মাছের বার্ষিক চাহিদা ৬৩ হাজার টন। বর্তমানে এই উৎপাদন ঠেকেছে ৬২ হাজার টনে। ঘাটতি রয়েছে এক হাজার টন। এ পরিস্থিতিতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প চালু নেই এ জেলায়। রাজস্ব খাতে মাঠ পর্যায়ে কিছ– কাজ চললেও প্রায় এক বছর ধরে জেলার মৎস্য অফিসগুলোয় কর্মকর্তারা কার্যত দাপ্তরিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। ফলে মাছ উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা রংপুর জেলায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রংপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্তু ৯ বছরে বিভিন্ন মেয়াদে কমপক্ষে পাঁচটি প্রকল্প চালু ছিল। এতে প্রতি বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মাছচাষি ও মাছ উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা উপকৃত হয়েছেন। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জেলায় চালু ছিল রংপুর বিভাগ মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প।

ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প চালু ছিল ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প (এনএটিপি-২) চলেছে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। ব্রুড ব্যাংক স্থাপন প্রকল্প ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এবং ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চলেছে জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য আবাসস্থল উন্নয়ন প্রকল্প।

এসব প্রকল্পের মাধ্যমে জলাশয় সংস্কার, অভয়াশ্রম স্থাপন, কমিউনিটি বেজড মৎস্য চাষ, আয়বর্ধক উপকরণ বিতরণ, সরকারি খামার উন্নয়নে উপকরণ সরবরাহ, সংস্কারমূলক হ্যাচারি স্থাপন, প্রদর্শনী, মাঠ দিবস এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। মূলত ২০২২ সালে চারটি প্রকল্প শেষ হয়েছে। শুধু এনএটিপি-২ প্রকল্প শেষ হয়েছে গত বছরের ৩০ জুন।

জেলার মাটি বেলে ও বেলে দো-আঁশজাতীয় হওয়ায় পুকুর, খাল ও বিলের পানি ধারণক্ষমতা কম। ফলে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চাষিদের মাছ উৎপাদন করতে হয়। তাই মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এ জেলার মাছ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট উপকারভোগীরা।

মিঠাপুকুর উপজেলার বালারহাট এলাকার একজন উদ্যোক্তা ও মাছচাষি মোখলেছার রহমান বলেন, আমি দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পরে দেশে ফিরে এসে ২০১৮ সাল থেকে মাছ চাষের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি। তিন একর ৩৭ শতক জমির মধ্যে পাঁচটি পুকুরে কার্প, ক্যাট ফিশ, দেশীয় প্রজাতির পাবদা, গুলসাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছি।

মাছ চাষের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মাটি পানি ধারণ করে রাখতে পারে না। এজন্য পুকুরে শ্যালো মেশিন দিয়ে প্রতিদিন পানি দিতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য কৃষিকাজে সেচের জন্য বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট বিল নেয়া হচ্ছে চার টাকা। এমনকি শতকরা ২০ ভাগ প্রণোদনাও দিচ্ছে সরকার। অথচ মাছ চাষের জন্য পানি নিতে মাছচাষিদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে ১৩ টাকা।

মোখলেছুর রহমান বলেন, বর্তমানে মাছের খাবারের দাম যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে প্রতি কেজি মাছ উৎপাদনে শুধু খাবার লাগছে ৯৩ টাকা। এছাড়া অন্যান্য উপকরণ যোগ করলে প্রতি কেজি মাছ উৎপাদন করতে প্রায় ১৫০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদিত মাছের দাম সেই অনুপাতে পাচ্ছে না চাষিরা। কিছুদিন আগে স্থানীয় মৎস্য অফিস থেকে প্রকল্পের মাধ্যমে তার পুকুরে দেশীয় প্রজাতি মাছের প্রদর্শনী করা হয়।

বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের আনন্দপাড়ায় ছয় একর আয়তনের জমিতে ১০টি পুকুরে তেলাপিয়া এবং মিশ্র ধরনের মাছের চাষ করছেন জাহানুর হক। রংপুর মহানগরীর এই বাসিন্দা বলেন, দিন দিন মাছ চাষ বেশ ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। তাই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সহায়ক প্রকল্প কার্যকরভাবে চালু থাকা জরুরি।

এনএটিপি-২ প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি পুকুরে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য ১০টি অ্যারটর মেশিন নিয়েছেন। অবশ্য মেশিনগুলোর মোট মূল্য সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে তিনি দিয়েছিলেন আড়াই লাখ টাকা, বাকি টাকা প্রকল্পের মাধ্যমে পেয়েছিলেন।

রংপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট পুকুর আছে ৪২ হাজার ৩৩৯টি, যার আয়তন আট হাজার ৪৪৯ দশমিক ৭৫ হেক্টর। এর মধ্যে সরকারি পুকুর আছে ১০২টি, যার আয়তন হচ্ছে ৮৬ দশমিক ৭৫ হেক্টর। বেসরকারি পুকুরের সংখ্যা হচ্ছে ৪২ হাজার ২৩৭টি, যার আয়তন হচ্ছে ৮ হাজার ৩৬৩ হেক্টর।

সরকারি বিল আছে ১৩৭টি (আয়তন ৬৯৭ দশমিক ৫৯ হেক্টর)। বেসরকারি বিল আছে ১২২টি (আয়তন এক হাজার ৩১৬ দশমিক ০১ হেক্টর)। সরকারি প্লাবনভূমি ১৯টি এবং প্লাবনভূমি আছে ১৯৯টি। খাল আছে ১১টি এবং নদী আছে ছয়টি (আয়তন দুই হাজার ২৫০ হেক্টর)। এছাড়া বাণিজ্যিক মৎস্য খামার আছে ৮৯৪টি (আয়তন এক হাজার ৮৭৭ দশমিক ৪০ হেক্টর।)

বর্তমানে জেলায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে কোনো প্রকল্প চালু নেই বলে জানিয়েছেন রংপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান মানিক। তিনি বলেন, প্রকল্প না থাকলে মাছচাষিদের মাঝে নতুন প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় না।

তিনি আরও বলেন, জেলায় পুকুর ও খাল-বিলে পানি ধারণ ক্ষমতা কম, তাই চাষিদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে মাছ চাষ করতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অভিজ্ঞতা বিনিময় খুবই প্রয়োজন। অন্য জেলার কোথাও বিশেষ কোনো মাছ চাষ খুবই ভালো হচ্ছে কি না, তা যদি রংপুর জেলার চাষিদের নিয়ে স্বচক্ষে দেখানো হয়, তাহলে অনেকে মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। কিন্তু প্রকল্প না থাকলে তা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে অনেককে একযোগে সহায়তা করাও সম্ভব।