মুসলিম বিশ্বের পবিত্র ইদুল আজহার মাত্র আর কয়েকদিন বাঁকি। ঈদকে কেন্দ্র করে সপ্তাহের দু-দিন রোববার ও গতকাল বুধবার বসেছিল রাজশাহীর সিটি পশুর হাট। ঈদের আগ পর্যন্ত চলবে প্রতিদিনই। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাটে জমে উঠেছে গরু কেনা-বেচা। তবে বিক্রেতারা বলছেন, গতবছরের তুলনায় পানির দামে গরু বিক্রি করছেন তারা। প্রতি বড় গরুতে নাই হয়ে গেছে পনের থেকে বিশ হাজার টাকা। ছোট গরুর দামও তুলনামূলক কম।
বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের পরিচালক উত্তম কুমার দাম জানান, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় মোট কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ২৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৬০টি। এসব পশুর ২০ শতাংশ অনলাইনে আর বাঁকি ৮০ শতাংশ গরু প্রচলিত হাটে বিক্রি হবে। গতবারের তুলনায় এবার অনলাইনে সাড়া পেলেও মানুষ সরাসরি হাটে গিয়ে পশু কেনা পছন্দ করেন। লকডাউনে গতবছরের তুলনায় দামও কম।
গতকাল বুধবার (১৪ জুলাই) সাপ্তাহিক হাটে দেখা গেছে গরু, মহিষের সরবরাহ বেশ ভালো থাকলে দূর-দূরান্তের পাইকাররা আসতে পারেননি। তাই বড় গরুর বেচা-কেনা কম হতে দেখা গেছে। মাঝারি ও কোরবানিযোগ্য ছোট গরুর চাহিদা থাকায় অপেক্ষাকৃত বেশি বিক্রি হয়েছে। আমদানি বেশি হওয়ায় দাম কম বলে জানিয়েছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাটে পশুর সরবরাহ ছিল চোখে পড়ার মত। বিক্রেতারা পশু নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সেই অনুযায়ী ক্রেতা নেই। মলিন মুখে দাঁড়িয়ে বিক্রেতাদের হতাশা প্রকাশ করত দেখা গেছে। আনুমানিক ১১ থেকে ১২ মণ ওজনের ষাঁড় গরু ২ লাখ ৪০ থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
গরু ব্যবসায়ী উসমান আলী জানান, তিনি জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বাড়ি বাড়ি গরু কিনে এসে হাটে এই বিক্রি করেন। গতবারে যেসব গরু ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন সেসব গরু এবার ১ লাখ ৪ হাজার কিংবা ৫ হাজার টাকা বলছেন ক্রেতারা। ঈদের এই সময় হাট জমজমাট থাকে। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ভিড় থাকে। হাক-ডাক বেশ ভালোই থাকে। কিন্তু এবার গরুর সরবরাহ ভালো থাকলেও ক্রেতারা এখনো হাটে তেমন আসছে না। যারা আসছেন তারাও তেমন দাম বলছেন না।
তিনি আরো জানান, এসময় বাইরের বড় বড় ব্যবসায়ীরা হাটে আসেন। পছন্দের গরু দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। কিন্তু এবার বাইরে থেকে লকডাউনের কারণে আসতে পারছেনা। তাই গরু বেচতে পারিনা এভাবেই দাঁড়িয়ে আছি।
নরসিংদী থেকে আসা ক্রেতা জুনাঈদ হাসান জানান, ঈদের এক সপ্তাহ আগেই তারা কোরবানির পশু কিনে থাকেন। প্রতিবছর ৫০ লাখ টাকার গরু কিনেন। এবার দাম একটু কম থাকায় আরো বেশি কিনবেন। এবারও এক সপ্তাহের আগেই এসেছেন। হাটে পছন্দসই ভালো পশু আছে। দুপুর পর্যন্ত কয়েকটি গরু দেখেছেন। ১১ টা নিয়েছেন। পছন্দ হলে আরো নিবেন।
স্বাস্থ্যবিধি ব্যাপারে তিনি জানান, গরুহাটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করাটা খুবই কঠিন। এখানে যারা বিক্রেতা আছেন তাদের একটা বড় অংশ এ বিষয়ে সচেতন থাকেনা। একারণে কারো কাছে মাস্ক থাকলেও তা থাকছে নাকের নিচে। এছাড়া হাটে প্রচুর পরিমানে চারিদিকে কাঁদা। ভাগাড়ের দুর্গন্ধ। সবমিলিয়ে এখানকার পরিবেশটা মোটেও সুস্থ্যকর নয়। এখানকার প্রশাসনের নজর দেওয়া উচিৎ।
ব্যবসায়ী শাহীন হোসেন জানান, এখনো হাটের পরিস্থিতি তেমন বোঝা যাচ্ছে না। এসময় বেচাকেনার জন্য বেশ জমজমাট হয়ে থাকে। এবার মানুষ আসে না। দুই একজন আসলেও গরুর দাম তেমন বলছেনা। এবারের হাটও অন্যবারের মত তেমন জমে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত কী হবে বলা যাচ্ছে না।
ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গতবারের চেয়ে এইবার গরু প্রতি ১৫ থেকে বিশ হাজার দাম কম। গরুর উৎপাদন খরচ বাড়লেও সেভাবে বাড়েনি গরুর দাম। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গরুর খাদ্য কিনতে হচ্ছে বেশি দাম দিয়ে। আগে যেই খাদ্যের দাম ১শ টাকা ছিলো সেই খাদ্য এখন ২ থেকে আড়াই’শ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। একটা গুরু প্রতিদিন ৫ থেকে ৬শ’ টাকার খাবার খাচ্ছে সেই হিসেবে দাম একটু বেশি ডাকতে হচ্ছে। লোকসান দিয়েও গরু বিক্রি করছেন খামারিরা ।
হাটে অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে বসেছে ভেটেরিনারি টিম। পবা উপজেলার প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, গরুর কোনো অসুখ বিসুখ হলে তারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত জটিল কোনো রোগ নিয়ে তাদের কাছে আসেনি। আসলে তারা সেটির জন্য কোনো চিকিৎসা ফি নেবেন না। এছাড়া যারা এখনো এসেছেন তাদের কোনো চিকিৎসা ফি নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বড় পশুর হাট সিটিহাটের ইজারাদার আতিকুর রহমান কালু বলেন, ঈদের আগে সাপ্তাহিক হাট হিসেবে আমদানি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। কিন্তু হাটে বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখনো সেইভাবে আসেনি। করোনার কারণে বাইরে থেকে ব্যাপারীরাও আসছেন না। স্থানীয় পর্যায়ের কিছু ক্রেতা দেখেশুনে গরু কিনছেন। গত রোববার ও বুধবার দুই হাট মিলিয়ে চার হাজারের মতো গরু-মহিষ কেনাবেচা হয়েছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমণ ঝুঁকি বিবেচনায় মাইকিং করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে সতর্ক করা হচ্ছে। প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়েছে। এখানে পুলিশ সদস্যরা আছেন তারাও সতর্ক করছেন। সবমিলিয়ে তারা স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে সচেষ্ট আছেন।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো: ইসমাইল হক জানান, রাজশাহীতে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৭০৭ টি গবাদি পশু। পশুর যোগান বেশি থাকায় এবার ঈদ বাজার খামারি ও ক্রেতা উভয়ের অনুকূলে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত থেকে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে গরু আমদানি বন্ধের বিষয়ে একটা সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই খামারিরা ভালো দাম পাবেন। এইবার কোরবানির জন্য দেশে পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। নিজেদের পশু দিয়েই দেশে কোরবানির পশুর চাহিদা মিটাতে পারবে। বরং এই পশুই চাহিদার চেয়ে বেশি আছে।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘদিনের লকডাউনে খামারিরা তাদের এই বিপুলসংখ্যক পশু নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। বিষয়টি মাথায় রেখে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত জুনের প্রথম থেকেই অনলাইনে পশু কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। এতে বর্তমানে রাজশাহীর পশু ব্যবসায়ীদের খামারের পশু ভালো বেচাকেনা হচ্ছে। দুশ্চিন্তাও দূর হয়েছে।
আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় এবারের ঈদে মোট কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ১৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৬০।ষাঁড় রয়েছে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ টি, বলদ রয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ১৯০টি। এছাড়া ৮৬ হাজার ৩৫২ গাভি, ২৫ হাজার ২৬১ মহিষ, ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩২ ছাগল এবং ১৪ লাখ ৪০ ভেড়া। ৪৭৮টির মতো রয়েছে অন্যান্য পশু।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৬ জুলাই ২০২১