রাজশাহীতে ৭০ শতাংশ পোল্ট্রি খামার বন্ধ

260

পোল্ট্রি খাতের নানা টানাপোড়নে রাজশাহীতে প্রায় ৭০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে খাদ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে খুব শীঘ্রই আরো ১০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে যেতে পারে; দেখা দিতে পারে প্রাণিজ প্রোটিন সংকট। এর প্রভাবে দাম বেড়ে বাজারে মুরগির মাংসের কেজি গরুর সাথে পাল্লা দিতে পারে! রাজশাহী পোল্ট্রি ফিড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও বিভাগীয় ডিম আড়ত সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন এসব তথ্য জানিয়েছেন।

জয়নায় আবেদীন বলেন, কোন পূর্বাভাস ছাড়াই হটাৎ খাদ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। ৫০ কেজি ওজনের প্রতিবস্তা খাদ্যে দাম গত সপ্তাহে বেড়েছে ১০০ টাকা। কোন কোন কোম্পানি কেজিপ্রতি আড়াই টাকা বাড়িয়েছে। প্রান্তিক খামারিদের এই সেক্টর থেকে উৎখাত করে কিছু কোম্পানির কাছে একক কেন্দ্রীভূত করাই সিন্ডিকেটের মূল লক্ষ্য। যাতে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র খামারিরা উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ফলে যেসব বড় কোম্পানি তিন-চার লাখ মুরগি বাণিজ্যিকভাবে পালন করছে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। নিজস্ব বাচ্চা, খাদ্য, ভ্যাকসিন দিয়ে উৎপাদন খরচ কম পড়ায় তাদের সাথে প্রান্তিক খামারিরা পাল্লা দিতে পারছেনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নারিশ ফিড, সিপি বাংলাদেশ, প্যারাগন ফিডসহ অন্তত ১০ টি কোম্পানির তথ্যে একই মিল পাওয়া যায়। পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্টানগুলোর প্রতিকেজি খাদ্যে বেড়েছে ২ টাকা। যা হিসেব করলে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১০০ টাকা। খামারিরা বলছেন, করোনাকালের শুরু থেকে প্রতিবস্তা পোল্ট্রি খাদ্যে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২১’শ টাকার খাদ্যের বস্তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৮’শ ৫০ টাকায়।

জানতে চাইলে নারিশ কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার ডা. আব্দুর রহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “খাদ্যের দাম বাড়তেই আছে। বর্তমানে নারিশের একবস্তা খাদ্যের দাম ৩১’শ ৬৭ টাকা। প্রতিকেজি খাদ্যের দাম পড়ে ৬৩ টাকা ৩৪ পয়সা। গত কয়েক মাসে ৭-৮ বার বেড়েছে খাদ্যের দাম। কমবে বলে মনে হয়না। খাদ্যের কাঁচামাল বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় ফলে খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। আমাদের কিছু করার নাই।”

রাজশাহীতে এ বিপুল পরিমাণ খামার বন্ধের কারণ জানতে চাইলে রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, রাজশাহীতে ৭০ শতাংশের বেশি পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়েছে। বাড়তি দামে খাদ্য, ভ্যাকসিন, খামারের কর্মচারীর বেতন, সেই অনুযায়ী ডিম ও মাংসের দাম না থাকায় সবমিলিয়ে নাজেহাল খামারিরা। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতিপিস লাল ডিম ১০ টাকা বিক্রি হলেও খামারিদের পকেটে ঢুকছে মাত্র ১ টাকা। খামারি পর্যায়ে ৮ টাকার বেশি দাম পান না তারা। প্রতি ডিমে উৎপাদন খরচ হয় ৭ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে অস্বাভাবিক বাড়তে পারে পোল্ট্রি পণ্যের দাম। ডিমের পিস ১৫ টাকা আর মুরগির কেজি সর্বনিন্ম ২০০ টাকা লাগবে এটা বলা যায়।

খাদ্যের দাম বাড়ানো বিষয়ে প্রতিষ্টানগুলো বলছে, খাদ্য তৈরির কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মূলত বেড়েছে খাদ্যের দাম। আমদানি করা সয়াবিন তেল, ভুট্টা, রাইস পলিসের দাম বেড়েছে। বৈশ্বিক দাম বাড়ায় খাদ্যের দাম বাড়ছে। ফলে খামার বন্ধ হয়ে পোল্ট্রি পণ্যের দাম বাড়ছে।

পবা উপজেলার পারিলা তরক গ্রামের পোল্ট্রি খামারি রেজউল বলেন, আগে পোল্ট্রিতে লাভ ছিল। এখন একটা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে পোল্ট্রি খাত ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গেছে। সরকারি ভাবে সিন্ডিকেট রোধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। যেসব খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ঋণের দায়ে সেসব খামারকে দাদন দিয়ে কন্টাক্ট করে নিচ্ছে কিছু সিন্ডিকেট। যারা খামারের মালিককে শ্রমিক বানিয়ে ছাড়ছে।

পোল্ট্রি সেক্টরের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে একটি ডিমের উৎপাদন ও তা’ পাইকারী পর্যায়ে বিক্রি পর্যন্ত খামারীদের খরচ পড়ে ৭ টাকার বেশি। সেইসাথে আশানুরুপ দাম না পাওয়ায় লোকসান না হলেও এভাবে চলতে থাকলে খামারে কর্মরত শ্রমিক, মুরগির ভ্যাকসিন, খাদ্যেও দাম বৃদ্ধি সব মিলিয়ে ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ছে। কয়েকমাসে তা মূলধনে আঘাত করবে। ইতোমধ্যে কিছু প্রান্তিক খামরি ব্যবসা ধরে রাখতে ব্যাংক ঋণ, এনজিও, ধার-দেনা ছাড়াও জমি বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহসিন বলেন, পোল্ট্রি খামারিদের দেখার কেউ নাই। সরকারের উচিত পোল্ট্রি সেক্টরকে তদারকি করা। এদিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। যদি এখন এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে পোল্ট্রি খামারিরা নিঃস হয়ে পড়বে। লোকসানে জীবনের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে যাবে। কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যাবে কোটি জনগণ। তখন তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই ডিম-মুরগি কিনতে হবে।

তিনি আরোও বলেন, বৈজ্ঞানিকভাবে সচেতন হয়ে পোল্ট্রি ব্যবসায় আসা প্রয়োজন। অনেক সময় মুরগি মারা যাওয়ার ফলে লোকসান গুণতে হয় খামারিদের। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দফতরকে আরো এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া পোল্ট্রি খাদ্য তৈরির কাঁচামাল সয়াবিন, ভুট্টাসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। সেক্ষেত্রে প্রডাকশন কমে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। খাদ্যের মানও আগের মতো নেই। ডিম কম পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপ ও চীন থেকে মূলত এসব পণ্য আমদানি করতে হয়। সেখানেই দাম বেড়েছে তাই খাদ্যের দামও বেড়েছে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৯মে ২০২২