ইলিয়াস আরাফাত, রাজশাহী ব্যুরো : যখন ফলন উঠে, তখন থাকে না দাম। এমন ঘটনা প্রতি মৌসুমেই। ক্রমাগত লোকসানের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা।
এই অঞ্চলে ফসলি জমিতে প্রতি বছর কমছে ধানের আবাদ। কৃষকরা ঝুকছেন অন্য ফসলের দিকে। আলু, পটোল, করলা, পেঁপে ভুট্টাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া ক্রমেই অবৈধভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বাড়ছে পুকুর খননের হিড়িক। এসব কারণে কমছে ধান চাষ।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক আসাদ জানান, ধান চাষে দিনে দিনে খরচ বাড়ছে। কিন্তু দাম বাড়ছে না। সেজন্যই প্রতিবছর কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়ছে। এছাড়া প্রতিবছর সেচ নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই জমির মালিকরা ধানের বিকল্প খুঁজছে। তারা বিকল্প হিসেবে সবজি ও ফল চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
রজাশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় গেল বছর রাজশাহীর নয়টি উপজেলায় ধানের আবাদ কমলেও বৃদ্ধি পেয়েছে সবজি, আলু ও পেয়ারাসহ ভুট্টা, পেঁয়াজ ও রসুনের চাষ। মূলত জমিতে সেচের প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি উৎপাদনের পর ধান বিক্রিতে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কৃষকরা তাদের জমিতে ধানের তুলনায় সবজি, ফলসহ অন্যান্য ফসল চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে বেশি।
কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১০ সালে এই জেলায় মোট ১৯ হাজার ৪০৮ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদিত হতো তিন লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন। আর সম্প্রতি ২২ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে চার লাখ দুই হাজর ৭৯০ মে. টন সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। একই সময়ে ৩৫ হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদিত হতো ৮ লাখ ৭৫ হাজার মে. টন। এখন তা ৪০ হাজার ৩৬১ হেক্টর জমিতে উৎপন্ন হচ্ছে ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮০ মে. টন।
এ সময়ে পেয়ারা উৎপাদিত হতো ৬৯০ হেক্টর জমিতে ৭ হাজার ৩১৪ মে. টন। বর্তমানে এই ফলের আবাদ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চার হাজার ৪২৮ হেক্টর জমিতে বর্তমানে পেয়ারা উৎপাদিত হচ্ছে এক লাখ ৫ হাজার ১২০ মে. টন। ভুট্টা উৎপাদিত হতো ১১ হাজার ৭৭৪ হেক্টর জমিতে ৫৬ হাজার ৮৬৯ মে. টন। বর্তমানে ১৫ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে উৎপন্ন হচ্ছে এক লাখ ৫ হাজার ৯১৯ মে. টন। আম ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে দুই লাখ ২২ হাজার ৫৩৯ মে. টন উৎপাদিত হতো। সর্বশেষ হিসেবে ১৭ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদিত হয় দুই লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ মে. টন।
এছাড়া পেঁয়াজ ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে এক লাখ ৪৪ হাজার ৯৮৬ মে. টন উৎপাদিত হতো। বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে দুই লাখ ৩ হাজার ৯৪৬ মে. টন। শুধু তাই নয় সময়ের ব্যবধানে ধানের আবাদ কমে গিয়ে বেড়েছে মাছ চাষ। একই সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে আদা, রসুন ও হলুদ চাষের পরিমাণ।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুল হক জানান, বোরো ধান চাষে পানির প্রয়োজন বেশি। বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো চাষে কৃষকদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। যা প্রকৃতির জন্য হানিকর। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের বোরো চাষে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে এই অঞ্চলের কৃষকদের আলু, ভুট্টা ও পেয়ারাসহ আউশ ও রোপা আমন চাষে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। এখন রাজশাহী জেলা সবজি চাষে দেশে শীর্ষে অবস্থান করে নিয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুল হক জানান, গত ১০ বছরের তুলনায় রাজশাহীর কৃষি জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যে জমিতে ১০ কেজি ফসল উৎপাদিত হতো এখন সেই জমিতে ফসল ভেদে ৩ থেকে ৫ কেজি ফসল বেশি উৎপাদন হচ্ছে। যে জমিতে গত আট বছর আগে হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিল ৩ দশমিক ৭২, সেখানে বর্তমান চিত্র ৪ দশমিক ২৫। একই সময়ে সবজি উৎপাদন ছিল ১৭ দশমিক ৪২, সেখানে বর্তমানে একই জমিতে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ১৮ দশমিক ১২।
এছাড়া জেলায় বেড়েছে কলা ও পেঁপের উৎপাদনও। তিনি জানান, পেঁপে আবাদে রোগ-বালাই কম, পানি সেচ দিতে হয় না। খরচও অনেক কম। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি এবং রোগ-বালাই কম তাই কৃষকেরা পেঁপে চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/ মোমিন