মাহী ইলাহি, রাজশাহী থেকে: এক দশক আগেও বারনই নদীর পানি ছিল টলটলে পরিষ্কার। নদীতে ছিল প্রচুর মাছ। কিন্তু এখন সেসব স্মৃতি। এখন দূষিত হয়ে উঠেছে রাজশাহীর পবা উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এ নদীটি। কারণ, শহরের সব বর্জ্য পানি নদীটিতে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। ফলে নদীর দূষিত পানিতে এখন মেলে না কোনো মাছ। তাই বাধ্য হয়ে পেশা বদল করতে হচ্ছে নদীপাড়ের জেলেদের।
বারনই নদীর পানি ব্যবহার করে এখন কোনো ফসলও ফলে না। এখন বর্ষাকাল পেরুলেই উৎকট গন্ধে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাই কঠিন হয়ে ওঠে। শহরের ড্রেন দিয়ে নেমে যাওয়া কেমিক্যালমিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য বারনইয়ের পানিকে এমন দুর্গন্ধময় আর দূষিত করে তুলেছে। পবার দুয়ারী ও মহনন্দখালী খাল হয়ে শহরের বর্জ্য গিয়ে মিশছে বারনই নদীতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী শহরের সব বর্জ্য এখন নগরীর উপকণ্ঠ সিটিহাটের পাশের একটি ড্রেন দিয়ে দুয়ারী খালে এবং গাঙ্গপাড়া এলাকার আরেকটি ড্রেন দিয়ে পবার মহানন্দখালি খালে ফেলা হচ্ছে। অথচ খাল দুটি এক সময় নদী ছিল। দখল আর দূষণে নদী দুটি আলাদা দুটি খালে পরিণত হয়েছে। এ দুটি খাল হয়েই শহরের সব ধরনের বর্জ্য মিশ্রিত পানি এখন বারনই নদীতে গিয়ে পড়ছে।
এতেই দূষিত হয়ে উঠেছে নদীটির পানি। পবার দুয়ারী ও বায়া-মহানন্দখালী খালে গিয়ে দেখা যায়, কালচে দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে গজ, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ও ওষুধের বোতলসহ নানা ধরনের বর্জ্য পদার্থ ভাসছে।
স্থানীয়রা জানালেন, রাজশাহী শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও কিনিক থেকে এসব বর্জ্য খালে আসে। দূষিত এই পানিতে নামলে নানা ধরনের চর্মরোগ হয়। তাই কেউ সে পানিতে নামেন না। অথচ কয়েক বছর আগেও খালগুলো মাছচাষিদের মাঝে ইজারা দিত উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু মাছ ছাড়ার পর মরে ভেসে ভেসে ওঠার কারণে এখন আর কেউ খাল দুটি ইজারা নেন না।
মহানন্দখালী খালের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা হালদারপাড়া গ্রাম। এই গ্রামে আগে ৬৫টি জেলে পরিবারের বসবাস ছিল। এখন প্রায় সবাই পেশা বদল করেছেন।
ওই গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ হালদার বলেন, খালের কালচে রঙের পানি গিয়ে মিশেছে বারনই নদীতে। এ কারণে নদীতেও মেলে না মাছ। তাই নদীনির্ভর জেলে সম্প্রদায়ের মানুষগুলো টিকে থাকার জন্য এখন অন্যের পুকুরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অনেকে নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন।
প্রশান্ত হালদার নামে এক ব্যক্তি বলেন, এক সময় দুটি খাল ও বারনই নদীতে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। তাদের জীবিকা নির্বাহে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন খালের দূষিত পানিতে একটি মাছও নেই। খালের স্লুইসগেট খোলা থাকলে নদীতেও মেলে না মাছ। এতে মানবেতর জীবনযাপন করেন জেলেরা। বাধ্য হয়ে তারা পেশা পরিবর্তন করছেন।
এই গ্রামের শিবু হালদারের ৩০ বছর কেটেছে পানিতে। খালে-নদীতে মাছ ধরতেন, বাজারে বিক্রি করতেন। ভালোই কাটতো তার দিন। কিন্তু শিবু হালদার এখন ভালো নেই। তার হাতে জাল নেই। কয়েক বছর আগেই পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। এখন তিনি ডাবের ব্যবসায়ী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ডাব কেনেন, বাজারে বিক্রি করেন। এভাবে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় শিবুকে।
শিবু বলেন, খাল দুটির পানি এতই দূষিত, সেখানে একটি মাছও বাঁচতে পারে না। খালে পানির চাপ বেড়ে গেলে স্লুইসগেট খুলে দেয়া হয়। তখন খালের পানি নদীতে নামে। এতে নদীর সব মাছ মরে ভেসে ভেসে ওঠে। তাই দাদন নিয়ে নৌকা-জাল তৈরি করে নদীতে নামলেও কোনো মাছ পাওয়া যায় না। এ জন্য বাধ্য হয়েই তিনি পেশা পরিবর্তন করেছেন।
শাকিমদুয়ারী গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান জানান, গ্রীষ্ণকালে খাল দুটিতে পানি কমে আসে। প্রখর রোদে তখন দূষিত পানি থেকে উৎকট গন্ধ ছড়ায়। এতে খালের পাশের বাসিন্দাদের টেকাই মুশকিল হয়ে পড়ে। দুটি খাল আর নদীর পানি দিয়ে ফসল চাষাবাদও করা যায় না। সেসব পানির সংস্পর্ষে গেলেই শরীরজুড়ে দেখা দেয় চর্মরোগ।
পরিবেশ অধিপ্তরের রাজশাহী অফিসের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ বলেন, মহানন্দখালী ও দুয়ারী খালের জীববৈচিত্র্য রায় সেখানে শহরের বিষাক্ত পানি না পাঠানোর জন্য সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি, চিঠির জবাবও দেয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
পবা উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খায়রুন্নেশা বেগম বলেন, বারনই নদীর পানি পবা ছাড়িয়ে পুঠিয়া উপজেলায় ঢুকে সেখানেও পরিবেশের দূষণ করছে। এ জন্য খাল দুটিতে নালার সংযোগ বন্ধ করার জন্য তিনিও সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, সিটি করপোরেশন পবার যে দুটি খালে বর্জ্য ফেলছে তা আসলে দুটি নদী। এর বায়া এলাকাটির নাম বারাহী নদী এবং দুয়ারীটির নাম নবগঙ্গা নদী। দখল আর দূষণে নদী দুটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দখল-দূষণমুক্ত করে এই নদী দুটিকে আগের অবস্থায় আনা দরকার।
জানতে চাইলে রাসিকের সচিব খন্দকার মাহবুবুর রহমান বলেন, খাল দুটির গতিপথ পরিবর্তন করে দূষিত পানি অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। শহরের কাছে পদ্মা নদীতে এসব পানি ফেলা যায়। তবে এমনটি করলে তির পরিমাণ আরো বাড়বে। তাই বাধ্য হয়েই শহরের বর্জ্য-পানি বারনাইয়ের দিকে পাঠানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, খাল দুটির প্রথম অংশে দুটি পানি শোধনাগার প্লান্ট বসানো গেলে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু প্লাট বসাতে যে অর্থের প্রয়োজন তা সিটি করপোরেশনের নেই। তাই সমস্যা সমাধানে তারাও সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। বিদেশি কোনো দাতা সংস্থাকে দিয়ে প্লান্ট বসানোর জন্যও তারা চেষ্টা করছেন।
লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ
যশোরে বৃষ্টিতে নষ্ট ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অগ্রিম সিম চাষ
ঝিনাইদহে সবজির ভালমানের চারা উৎপাদন বিষয়ক প্রশিক্ষণ
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম