আধুনিক পেশা হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে খামার প্রকল্প। মাছ চাষ তার মধ্যে অন্যতম। মাছ চাষ করে স্বনির্ভর হওয়া যায়। গ্রাম বাংলায় অর্থনৈতিক একটা বড় স্তম্ভই হচ্ছে মাছ চাষ। মাছ চাষীদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করে মৎস্য দপ্তর। নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে মাছ ও মাছের চাষ নিয়ে।
বাস্তবিক প্রয়োগও হচ্ছে, এই পরীক্ষালব্ধ প্রয়োগের বাস্তব পরিচয়ে ঘটেছে মাছ চাষীদের হাত ধরে। যার মধ্যে ইদানিং নতুন সংযোজন “জয়ন্তী রুই”। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া ব্লকে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে জয়ন্তী রুই এর চাষ হচ্ছে। মাছ চাষীদের মধ্যে “জয়ন্তী রুই” নামটি আসতে আসতে ব্যাপক পরিচিতি ঘটছে। এমনিতে কথায় আছে “মাছের রাজা রুই আর শাকের রাজা পুঁই” । মাছের মধ্যে রুই অন্যতম। আর এখন রুই মানেই জয়ন্তী রুই। এই মাছটি শুধু স্বাদের খনি নয়, একইসঙ্গে সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি।
কি এই জয়ন্তী রুই?
একই নদী বা একই পুকুরের জলের একই প্রজাতির মাছের মিলনে জন্ম নেওয়া রুই মাছ উন্নততর হয় না। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নরওয়ের গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় ভুবনেশ্বরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফ্রেশওয়াটার অ্যাকোয়াকালচার (আইসিএআর) ছ’টি ভিন্ন জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা ৬ ধরনের রুই-এর মিলনে নতুন এক ধরণের রুই মাছের জন্ম দিয়েছে। যার নাম ‘জয়ন্তী রুই’। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, শতদ্রু ও গোমতী— পাঁচটি পৃথক নদীর পাঁচ রকমের রুই মাছ ও ‘আইসিএআর’- এর নিজস্ব উৎপাদিত এক প্রকার রুইয়ের মধ্যে পর পর ন’টি প্রজন্মের মিলন ঘটানো হয়েছে। এ ভাবে জন্ম দেওয়া হয়েছে জয়ন্তী রুই-এর।
জয়ন্তী রুই মাছ চাষের সুবিধা অনেক। সাধারণ মাছের মতো চাষ পদ্ধতি হলেও এর বৃদ্ধি প্রায় ৩৩ থেকে ৪১ শতাংশ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী, দেখতে লালচে বর্ণের, সাধারণ রুই মাছের থেকে এই জয়ন্তী রুই এর মৃত্যুর হার অনেক কম এবং পচনশীলতা অনেক কম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এক বছরে দেড় কেজি পর্যন্ত এর ওজন হতে পারে।
জয়ন্তী রুই মাছ চাষের সুবিধা –
জয়ন্তী রুইয়ের বৃদ্ধির হারও অনেক বেশি। সাধারণ রুই-এর থেকে জয়ন্তী রুই-এর পচনশীলতাও অনেকটা কম। জয়ন্তী রুই-এর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বেশী। এই প্রজাতির রুই দেখতেও বেশ ভাল। দেশী রুই-এর গায়ের রং কালচে লাল। অন্যদিকে জয়ন্তী রুই হালকা লালচে সাদা রঙের, চকচক করে। জয়ন্তী রুই মাছের ডিমপোনার চাষ এ বাঁচার হার বেশী। সাধারণত সাধারণ রুই-এর ১০০টি ডিমপোনার মধ্যে ৪০% বাঁচে। জয়ন্তী রুই-এর ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৬০-৬৫%। জয়ন্তী রুই-এর চাষ লাভজনক ও খাদ্য হিসেবে সুস্বাদু। সাধারণ রুই মাছের মতোই এর চাষ পদ্ধতি। জয়ন্তী রুই একক চাষ না করে মিশ্র চাষ করলেই লাভ বেশী।
মাছের মিশ্রচাষে পুকুর প্রস্তুতি –
পোনা মজুদের পূর্বে ভালো করে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে, যাতে পুকুরে বেশি করে প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্ম হয়। জাল টেনে বা মহুয়া দিয়ে (১ ডেসিম্যালে আয়তনের ১ মিটার গভীরতা পুকুরে ১০ কেজি) রাক্ষুসে মাছ নিধন করতে হবে এবং জলজ আগাছা দমন করতে হবে। পরে প্রতি ডেসিম্যালে পুকুরে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের তিন দিন পর সার হিসেবে প্রতি ডেসিম্যালে পিছু ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও ৬-৭ কেজি পঁচানো গোবর-জল প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে সার প্রয়োগ করলে মাছের খাদ্য ( উদ্ভিদকনা ও প্রানীকনা) বৃদ্ধি পায় এবং মাছের উৎপাদন বেড়ে যায়।
মিশ্রচাষে পোনা মজুদ –
মিশ্র পদ্ধতিতে সাধারণ কাতলা, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মৃগেল এর সাথে জয়ন্তী রুই ছাড়া যায়। প্রতি ডেসিম্যাল পুকুরে ১২৫-১৫০ মিমি/৫-৬ ইঞ্চি সাইজের পোনা মাছ গুলি ছাড়লে ভালো। সেই হিসেবে জয়ন্তী রুই ৮ টি , কাতলা ৪ টি, মৃগেল ৬ টি, সিলভার কার্প ৬ টি, গ্রাসকার্প ২ টি , সাইপ্রিনাস কার্প ৪ টি মোট ৩০ টি মাছ ছাড়া যেতে পারে।
মাছ ছাড়ার পর কী কী পরিচর্যা করলে উৎপাদন ভালো হবে –
মিশ্র চাষ করার জন্য পুকুর সব সময় পরিষ্কার রাখা, মাঝে মাঝে পুকুরের জলে চুন ও সার দেওয়া, পুকুরে মাছকে পরিপূরক খাবার দেওয়া এবং মাঝে মাঝে জাল টানা দরকার। পুকুরের জলের গভীরতা ৬ ফুট থেকে ৭ ফুটের মতো হওয়া দরকার। কোন সময়ই এর বেশি জল পুকুরে রাখা ভাল নয়। এখন আমাদের রাজ্যের “মিঠা জল মাছ চাষ গবেষণা কেন্দ্র” কল্যানী, নদিয়ায় এই জয়ন্তী রুই এর প্রজনন করে সরকারী ছাড় দিয়ে মাছ চাষীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সারা রাজ্যে এই মাছের প্রসার আরো বাড়বে।
পরিশেষে বলা যায়, মাছচাষীদের চাষের ক্ষেত্র গুলি পরিদর্শন করে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, জয়ন্তী রুই এর ডিম পোনার চাষ করলে মাছ চাষীরা বেশি লাভবান হবে। সাধারণ রুই এর ডিম পোনা এর চেয়ে জয়ন্তী রুই-এর ডিমপোনন্র দ্বিগুণ এর বেশি বাঁচার হার। মাছ ধরার পর জয়ন্তী রুই মাছের পচন হয়ে দেরিতে, তাই অনেক সময়েই টাটকা থাকে। সুতরাং মাছ চাষীরা হবেন বেশী লাভবান। আর আপামর বাঙালি পাবে টাটকা স্বাস্থ্যকর রুই, জয়ন্তী রুই।
তথ্যসূত্রঃ কৃষি জাগরণ
ফার্মসএন্ডফার্মার/২১অক্টোবর২০