লাভজনক উপায়ে ব্রয়লার পালন করবেন যেভাবে

199

ব্রয়লার ফার্ম করে টিকে থাকতে হলে একজন খামারীর এই ব্রয়লার ফার্মিং ব্যবসার চরিত্র ভাল ভাবে অনুধাবন করা জরুরি। বুঝতে হবে ,টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থেকে লাভ করতে হবে। আবেগ বা কাল্পনিক লাভের হিসেব করে নয়।এখন পর্যন্ত মধ্যস্বত্ত ভোগী শ্রেনীর অস্ত্বিতের কারনে লাইভ ব্রয়লারের দামের উঠানামা, খাদ্যের দামের উচ্চ হার এবং রোগ ব্যাধির কারনে বেশীরভাগ ছোট খামারী পূঁজি খুইয়ে দায় দেনায় চক্রে পড়ে ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন।অন্যদিকে বড় প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমে ক্রমে তাদের পোল্ট্রি অপারেশানকে ইন্টিগ্রেশান বা সমন্বিত ফার্মিং সিস্টেম করার কারনে তাদের প্রতি কেজি লাইভ ব্রয়লারের উৎপাদন খরচ ছোট খামারীর থেকে অনেক কম হচ্ছে, ফলে ছোট খামারী ক্রমাগত উচ্চ উৎপাদন খরচের কারনে লোকসান দিচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতে ছোট এবং মাঝারী খামারীদের ব্রয়লার পালনের ব্যবহারিক এবং ব্যবসায়িক বাস্তব সম্মত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে নিজেদের ব্রয়লার ব্যবসায় উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে তাহলে শত ভাগ ঝুঁকির এই ব্যবসায় এক সময় লাভের মুখ দেখতে পাবেন।
লেখক অতি গুরত্বপূর্ন কিছু বিষয় সজহভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন আশা করা যায় এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান খামারীদের ব্রয়লার ফার্মিং ব্যবসায় অনেক কাজে আসবে।

খামারে বাচ্চা তোলার পূর্ব প্রস্তুতি: বাংলাদেশে সাধারনত ১.৫-২.০ কেজি ওজনের জীবন্ত ব্রয়লার মুরগীর চাহিদা সব চাইতে বেশী এবং ব্রয়লারের এই ওজন ২৮-৩০ দিনের মধ্যেই অর্জিত হয়,সে হিসাবে প্রতিটি ব্রয়লার ঘর থেকে(৩০-৩৫ দিন বয়স পর্যন্ত পালন করলে)বছরে ৬-৭ টি ব্যাচ ব্রয়লার উৎপাদন করা যায়।প্রতিবার ব্রয়লার বিক্রির পরে লিটার পরিস্কার করা, ধোয়া মোছা, চুন লাগানো, পর্দা লাগানো থেকে শুরু করে নতুন বাচ্চা তোলার উপযুক্ত করতে, যাবতীয় কাজ শেষ করতে প্রায় ১৫ দিনের মত সময় লাগে,এছাড়া আছে কোন সময় বাচ্চার দাম বেশী এবং পছন্দের হ্যাচারির বাচ্চা পেতে বিলম্ব ইত্যাদি সমস্যা।

প্রতিবারে নতুন করে বাচ্চা তোলার আগে বায়ো-সিকিউরিটির বিষয়টা সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে, কারন পূর্বের ব্যাচের অনেক রোগ-জীবানু খামারের চারপাশে, ঘরের ভিতরে থেকেই যায় ।সে জন্য যতটা পারা যায় জীবানু ধ্বংসের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে, ঘরের চারপাশে চুন ছিটাতে হবে,ঘরের দেওয়াল এবং ফ্লোরে চুনকাম করাতে হবে,খাদ্যপাত্র-পানির পাত্র,ব্রুডার এবং অন্যান্ন যন্ত্রপাতি জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে জীবানুমূক্ত করতে হবে।পর্দায় এবং ঘরের ভিতরের দিকের চালে শক্তিশালী স্প্রে-মেশিন দিয়ে জীবাণুনাশক বার বার স্প্রে করতে হবে।যতটা পারা যায় জীবানুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে এবং এর পরও যে সকল জীবানু থেকে যাবে সে গুলো যেন রোগ সৃষ্ঠির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সে দিকে অবশ্যই কড়া নজর দিতে হবে।বায়োসিকিউরিটির এই সকল কার্যক্রম গ্রহন করার মূল উদ্দেশ্য হল একদিন বয়সী বাচ্চার তেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না ফলে রোগজীবাণু সহজে এদের আক্রান্ত করে,এ জন্য একজন ব্রয়লার খামারীর মূল লক্ষ্য থাকতে হবে সদা সর্বদা নিজের স্বার্থে খামারকে সব সময় জীবানু মূক্ত রাখার চেস্টা করা।

লিটার হিসাবে তুষ উত্তম,কারন তুষে তেমন ফাংগাস জন্মায় না, যদি কাঠের ভূষি ব্যবহার করা হয় তাহলে যথা সম্ভব রোদে শুকিয়ে তার পরে ব্যবহার করা উচিৎ, অন্যথায় লিটার হিসাবে ব্যবহার করা কাঠের ভূষিতে যদি অধিক আদ্রতা থাকে তাহলে সেখানে ছত্রাক জন্মায়, যার প্রভাবে বাচ্চার বয়সের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ব্রুডার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাচ্চা খামারে আসার আগেই লিটারে কয়েক বার শক্তিশালী জীবাণুনাশক স্প্রে করে ওলট-পালট করে দিতে হবে যাতে লিটারের বেশীর ভাগ জীবানু মারা যায়।

বাচ্চার সংখ্যার অনুপাতে ৫০০ বাচ্চার জন্য এক একটি চিক গার্ডের মাধ্যমে ব্রুডিং এরিয়া প্রস্তুত করতে হবে।চিক গার্ডের উপর নির্দিষ্ট উচ্চতায় ব্রুডার ঝুলিয়ে দিতে হবে এবং প্রযোজনীয় সংখ্যক ইলেকট্রিক বাল্ব লাগাতে হবে। যদি ইনফ্রারেড গ্যাস ব্রুডার ব্যবহার করা হয় তাহলে তা হবে উত্তম ব্যবস্থা, কিন্তু আমাদের দেশের ব্রয়লার খামারীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করলে অনেকের পক্ষেই গ্যাস ব্রুডার ব্যবহার করা সম্ভব নয়।

অধিক শীতের সময় ঘরের তাপমাত্র ধরে রাখা সম্ভব না হলে, খামারীরা সাধারণত কাঠের ভূষির চুলা জ্বালিয়ে অথবা গ্যাসের চুলা দিয়ে তাপমাত্রা বাড়ানোর চেষ্ঠা করেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে ব্রয়লারের ঘরে প্রচুর ধোঁয়া সৃষ্ঠি হয় এবং কার্বন মনো অক্সাইড এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস তৈরি হয়, ফলে ঘরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, এই ধরনের পরিস্থিতিতে বাচ্চার তল পেটে পানি জমে, দৈহিক বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয় এবং অধিক সংখ্যায় বাচ্চার মৃত্যু হয়।যদি বাধ্য হয়ে চুলা জ্বালাতে হয় তবে সব সময় পর্দার উপরের দিকে ফাঁক রাখতে হয় এবং এই ফাঁক দিয়ে দূষিত গ্যাস বেরিয়ে যায় এবং বিশুদ্ধ অক্সিজেন ঘরে প্রবেশ করে এবং বাচ্চা অবস্থায় তল পেটে পানি জমার আশংকা অনেক কমে যায়।

ঘরে বাচ্চা তোলার ২৪ ঘন্টা পূর্বে ব্রুডার জ্বালিয়ে ঘরের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে এবং লিটারের উপরে যেন ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।ঘরের পর্দায় কোন ফুটো থাকলে তা মেরামত করতে হবে,যারা বাচ্চার ঘরে ডিউটি করবে তাদের জন্য আলাদা জুতা, ড্রেসের ব্যবস্থা করতে হবে,এই সকল ড্রেস কোন ভাবেই ঘরের বাইরে নেওয়া যাবে না এবং বাইরের ড্রেস বা জুতা নিয়ে ছোট বাচ্চার ঘরে প্রবেশ করা যাবে না।

ব্রুডিং হাউজে বে-দরকারি লোকের প্রবেশ কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রন করতে হবে।ব্রুডিং ঘরে দিনে নূন্যতম তিনবার ভাল ও শক্তিশালী স্প্রে মেশিন দিয়ে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে এবং এই স্প্রে করা যেন গাফালতির কারনে বন্ধ না হয় সেদিকে খামারিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ভাইরাস জনিতরোগ যেমন গাম্ববরো,রানিক্ষেত,বার্ড ফ্লু,ব্রংকাইটিস ইত্যাদি শুধুমাত্র জীবাণুনাশক স্প্রে,সঠিক বায়োসিকিউরিটি নিয়ন্ত্রন এবং ভ্যাক্সিনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।এটা সকল ব্রয়লার খামারীর মনে রাখতে হবে ভাইরাস জনিত রোগের কোন চিকিৎসা নাই।
বাংলাদেশের ব্রয়লার খামারীরা সাধারণত এই ভাইরাস জনিত রোগের কারনেই বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

যাদের সামর্থ আছে তাদের উচিৎ ব্রুডার হাউজ আলাদা করে ১৫ দিন সেখানে লালন পালন করে ব্রয়লার গ্রোয়িং হাউজে নিয়ে আসা এবং বিক্রি পর্যন্ত সেখানে লালন পালন করা।এই সিস্টেমে ব্রয়লার পালন করলে রোগের পাদূর্ভাব অনেকাংশে কমে যায়, ভাল ফলাফল পাওয়া যায় এবং সঠিক দৈহিক ওজন অর্জনের কারনে কমদামে ব্রয়লার বিক্রি করেও ভাল লাভের সম্ভাবনা থাকে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১২অক্টোবর ২০২২