লাভজনক থাই পেয়ারার চাষ

611

বিভিন্ন ভিটামিন সমৃদ্ধ এবং বহুবিধ গুণের জন্য পেয়ারাকে বলা হয় আপেল। তাছাড়া পেয়ারা খুবই জনপ্রিয় একটি ফল। বাংলাদেশের সর্বত্র কম-বেশি পেয়ারার চাষ হয়। দেশে বর্তমানে কমবেশী ২৫ হাজার হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেয়ারা উত্পন্ন হয়।

কয়েক বছর আগেও শীতকালে পেয়ারা পাওয়া যেত না। দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এখন শীতকালেও সুস্বাদু পেয়ারা পাওয়া যাচ্ছে। থাইল্যান্ড থেকে আসা থাই পেয়ারা-৫ ও থাই পেয়ারা-৭ অধিকতর গবেষণার পর এখন চাষ হচ্ছে সারা দেশে। বেশি ফলন ও ভালো দামের জন্য এ পেয়ারা এরই মধ্যে দেশের ফল চাষীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। বরিশাল, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া ও ঈশ্বরদীর অনেক ফলচাষী থাই পেয়ারা চাষ করে তাদের আর্থ- সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। অধিক

লাভ হওয়ার কারণে এ জাতের পেয়ারার চাষ সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। থাই জাতের পেয়ারার মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জাতটি হলো থাই পেয়ারা-৭। এগুলোর আকার গোলাকার, রঙ হলদে সবুজ এবং সাইজে বেশ বড়। প্রতিটি পেয়ারার ওজন গড়ে ৪০০ থেকে ৭০০ গ্রাম। গাছের উচ্চতা ২.৫ থেকে ১০ মিটার। ফুল ফোটা থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত ৯০ দিন সময় লাগে।

এ জাতের বড় বৈশিষ্ট্য হলো: বারো মাসই এর গাছ থেকে পেয়ারা পাওয়া যায়, বীজ কম ও নরম, অন্যান্য পেয়ারার থেকে স্বাদেও বেশি মিষ্টি ও কচকচে। বসতবাড়ির আঙিনায়, বাড়ির ছাদে বা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে এ জাতের পেয়ারা চাষ করা যায়। এ জাতের পেয়ারার চাহিদা বেশী থাকায় বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শহরে ১২০- ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত মানসম্পন্ন উদ্যান প্রকল্প থাই পেয়ারার চারা উৎপাদন করে বিক্রয় করে থাকে।

এ জাতটি চাষের জন্য আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়া খুবই উপযোগী। দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত সরকারি হার্টিকালচার সেন্টার, ব্র্যাক নার্সারিসহ বিভিন্ন নার্সারিতে এই পেয়ারার চারা পাওয়া যায়। চাষ পদ্ধতি ঃ অন্যান্য জাতের পেয়ারার মতোই জ্যৈষ্ঠ-আশ্বিন মাস পর্যন্ত থাই পেয়ারা-৭ এর চারা রোপণ করা যায়। এ পেয়ারা চাষের জন্য নিকাশযুক্ত বেলে দো-আঁশ মাটিই উত্তম। বংশবৃদ্ধির জন্য বীজ থেকে চারা বা গুটি কলম ব্যবহার করা উচিত। ৪ী৪ বা ৩ী৩ মিটার দূরত্ব ছকে এ জাতের পেয়ারার চারা রোপণ করতে হয়। রোপণের কয়েক সপ্তাহ আগে ৫০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, ৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ৫০ সেন্টিমিটার চওড়া গর্ত খনন করতে হবে। চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে প্রতিটি গর্তের মাটির সঙ্গে চারা ২০-২৫ কেজি পচা গোবর সার, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১৫০ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে দিতে হবে।

তার পর সার মিশ্রিত মাটি দ্বারা গর্ত ভরাট করে গর্তের ঠিক মাঝখানে চারাটি রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গর্তের চারদিকে মাটি দ্বারা উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে, যাতে বাইরের পানি এসে গাছের গোড়ায় না জমে। গাছটি যাতে বাতাসে হেলে না পড়ে সেজন্য বাঁশের খুঁটির সঙ্গে হালকাভাবে বেঁধে দিতে হবে। মাটিতে রসের অভাব হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। পেয়ারা গাছ থেকে অধিক ফলন পেতে পাঁচ বছরের নিচের একটি গাছে বছরে পচা গোবর ২০ থেকে ২৫ কেজি, ইউরিয়া ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম, টিএসটি ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ও এমওপি ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম এবং পাঁচ বছরের ওপরের প্রতিটি গাছে প্রতি বছর পচা গোবর ২৫ থেকে ৩০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম, টিএসপি ৪৫০ থেকে ৫৫০ গ্রাম, এমওপি ৪৫০ থেকে ৫৫০ গ্রাম সার ব্যবহার করতে হবে। উল্লিখিত পরিমাণ সার সমান দুইভাগে ভাগ করে বছরের ফেব্র“য়ারি-মার্চ এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

সার প্রয়োগের পর প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। অনেক সময় জিংকের অভাবে পাতার শিরায় ক্লোরোসিস দেখা যায়। সেক্ষেত্রে ৮০ লিটার পানিতে ৪০০ গ্রাম জিঙ্ক ও ৪০০ গ্রাম চুন মিশিয়ে গাছে ¯েপ্র করতে হবে। পেয়ারা সংগ্রহের পর ভাঙা, রোগাক্রান্ত ও মরা শাখা-প্রশাখা ছাঁটাই করে ফেলতে হবে। পেয়ারা গাছ প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক ফল দিয়ে থাকে। গাছের পক্ষে সব ফল ধারণ সম্ভব হয় না। তাই মার্বেল আকৃতির হলেই ঘন সন্নিবিষ্ট ফল ছাঁটাই করতে হবে। গ্রীষ্ম বা বর্ষা মৌসুমে গাছে বেশী ফল না রাখাই ভালো। এ জাতের পেয়ারা যেহেতু পুরো বছর জুড়ে ফল দেয়, তাই শীত মৌসুমের ফলন ভালো হলে চাষী বেশী লাভবান হবে।

রোগ বালাই: ছাতরা পোকা, সাদা মাছি পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা ও মাছি পোকাসহ বিভিন্ন রকমের পোকা দ্বারা পেয়ারার গাছ আক্রান্ত হয়। এসব পোকা-মাকড় দমনের জন্য সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। যেমন-মাটিতে পড়ে থাকা পোকা বা আক্রান্ত ফল কুড়িয়ে ধ্বংস করা, ফেরোমোন ফাঁদ ও বিষ টোপ ব্যবহার করা। মার্বেল আকার হলে পেয়ারা পলি দিয়ে মুড়ে দেয়া ইত্যাদি। সাদা মাছি দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে পাঁচ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে গাছে স্প্রে করা যেতে পারে। আর অন্যান্য পোকা দমনের জন্য পেয়ারা গাছে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর দুই থেকে তিনবার সিমবুশ বা মেলাথিয়ন জাতীয় কীটনাশকের যে কোনো একটি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া পেয়ারা গাছে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দেখা দিলে প্রথমে পেয়ারার গায়ে ছোট ছোট বাদামি রঙের দাগ দেখা দেয়। দাগগুলো ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে পেয়ারার গায়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে।

আক্রান্ত ফল পরিপক্ব হলে অনেক সময় ফেটে যায়। এ রোগ দমনের জন্য গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছে ফুল ধরার পর টপসিন-এম প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। ভালোভাবে যতœ নিলে একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে গ্রীষ্মকালে ৬০ থেকে ৭০ কেজি এবং হেমন্তকালে ৫০ থেকে ৬০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৩এপ্রিল২০