লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালন

1154

Farming_3

নাহিদ বিন রফিক: ‘লিটার’ শব্দের অর্থ পশুপাখির বিছানা। ঘরের মেঝেতে মুরগির মলমূত্র লেপ্টে যেন না যায় সেজন্য কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ, ছাই এসব দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিছানা তৈরি করা হয়। এ ধরনের বিছানাকে লিটার বলে। লিটার পুরু করে দিলে তাকে বলে ডিপলিটার। লিটারে ব্রয়লার আর ডিপলিটারে লেয়ার মুরগি পালন করা উত্তম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মুরগি খামারিদের প্রতিদিন ঘর পরিষ্কারে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। তাই এসব ঝামেলা এড়াতে তখন ঘরের মেঝেতে পুরু করে খড় বিছিয়ে রাখতো। ওই সময় থেকেই ডিপলিটার পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা দেশের সর্বত্র বিরাজমান।

লিটার ও ডিপলিটারের ঘর
লিটার ও ডিপলিটারে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে প্রমমেই চলে আসে এর বাসস্থানের কথা। মুরগির ঘর হতে হবে বেশ খোলামেলা। তা অবশ্যই পূর্ব-পশ্চিম দিক লম্বালম্বি করে তৈরি করতে হবে; যেন সূর্যের কিরণ সরাসরি মুরগির ঘরে প্রবেশ করতে না পারে এবং বাতাস ঘরের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘরে মেঝে পাকা হলে ভালো হয়। পরিমিত আলো বাতাস পাওয়ার জন্য ২ থেকে ২.৫ ফুট পাকা দেয়াল কিংবা বাঁশ দিয়ে বেড়া তৈরির করে এর ওপর ২.৫ থেকে ৩ ফুট বাঁশের চটি দিয়ে জালের মতো বেড়া দিতে হবে। মেঝেতে প্রতিটি ব্রয়লারের জন্য জায়গা প্রয়োজন শীতকালে এক বর্গফুট, গ্রীষ্মে দেড় বর্গফুট এবং লেয়ারের জন্য উভয় ঋতুতে দু’বর্গফুট করে। তবে মুরগির বয়স ও আকার ভেদে জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। ঘরে মূরগি দেয়ার ৩/৪ দিন আগে লিটার সাজাতে হয়। ঘর শুকিয়ে লিটারের জন্য ২ ইঞ্চি এবং ডিপ লিটার হলে ৬ ইঞ্চি পুরু করে উপকরণগুলো বিছাতে হবে।

খাদ্য সরবরাহ
স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মুরগিকে দৈনিক দু’বার বিশুদ্ধ পানিসহ পুষ্টিকর খাবার দেয়া প্রয়োজন। প্রতি ২৫ টি মুরগির ক্ষেত্রে একটি করে খাবার পাত্র (গোলাকার) এবং ৫০টি মুরগির জন্য একটি পানির পাত্র (গোলাকার) দরকার। ডিম পাড়া মুরগির বেলায় সুষম খাবারের অংশ হিসেবে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান অবশ্যই থাকা প্রয়োজন তা হচ্ছে- ১৬% আমিষ,৮% আঁশ, ৭% ঝিনুকচূর্ণ, ২ হাজার ৮শ’ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি ও পরিমাণমতো ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার।

আলো-তাপ ব্যবস্থাপনা
মুরগি পালনে কৃত্রিম আলো গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার জন্য ৪/৫ মাস পর্যন্ত তাপের ব্যবস্থা করতে হয়। তাপের পরিমাণ বাচ্চার বয়সের ওপর নির্ভর করে। বয়স যতো বাড়বে তাপের পরিমাণ ততো কমবে। ডিমপাড়া মুরগির জন্য ঘরে দৈনিক ১৬ ঘন্টা করে আলো প্রয়োজন। আলো এমন করে ঝুলাতে নেই যেন বাতাসে দোলে। কারণ এতে মুরগি ভয় পেতে পারে। হলুদ কিংবা লাল আলোতে ডিম উৎপাদন বেশি হয়। ঘরে কখনই উজ্জ্বল আলো দেয়া যাবে না। এতে পরস্পরের মধ্যে ঠোকাঠুকির অভ্যাস জন্মাতে পারে।

পরিচর্যা
মুরগির ঘরকে পষ্কিার পরিচ্ছন্ন রাখা বাধ্যতামূলক। সেইসাথে সকল সরঞ্জাম রাখতে হবে জীবাণুমুক্ত। লিটারকে শুকনো রাখতে প্রতিদিন একবার করে উপরের মলমূত্র নাড়াচড়া করতে হবে। ডিপলিটারে সপ্তাহে একবার কাঠ দিয়ে খুঁচিয়ে উল্টে-পাল্টে দিলে বর্জ্যগুলো মিশে যাবে। মাঝেমধ্যে চুন ব্যবহার করলে ভালো হয়। লিটার যাতে স্যাঁতসেঁতে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা বাঞ্চনীয়।

রোগবালাই প্রতিরোধ
মোরগ-মুরগি রোগাক্রান্ত হলে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা উত্তম। নির্দিষ্ট ব্যাক্তি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করা ঠিক নয়। যারা ব্যবস্থাপনার সাথে জরিত তারাই কেবল জীবাণুমুক্ত হয়ে মুরগির ঘরে প্রবেশ করবে। রোগজীবাণু ছড়ায় এমন প্রাণি বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, ইঁদুর এরা যেনো খামারে ঢুকতে না পারে সেদিক অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সেইসাথে রোগ হওয়ার আগেই নিয়ম অনুযায়ি বিভিন্ন প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। প্রতিদিন পর্যবেক্ষণের সময় কোনো মুরগি যদি অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে দেরি না করে প্রাণিসম্পদবিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মুরগি মারা গেলে অবশ্যই মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। অসুস্থ মুরগিকে দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।

পালন সুবিধা
লিটারে মুরগি পালনে সুবিধা অনেক। মুরগির পায়খানার সাথে মিশ্রিত মূত্র লিটারে শুষে নেয়। ফলে ঘর থাকে শুকনো এবং দুর্গন্ধমুক্ত। এতে মুরগি আরাম অনুভব করে। শীতকালে শীত থেকে রক্ষা করে এবং গ্রীষ্মেও পায় স্বস্তি। এছাড়া মাছির উপদ্রব কম হয়। খাঁচায় পালন পদ্ধতিতে তারের সঙ্গে অনবরত ঘর্ষণের ফলে মুরগির পায়ের নিচে ফুলে যায় এবং পরে ক্ষত সৃষ্টি করে। কিন্তু লিটার পদ্ধতিতে এরকম হওয়ার আশংকা নেই। ডিপ লিটার প্রতিদিন পরিষ্কারের প্রয়োজন হয় না। লিটার প্রক্রিয়াজাত করে হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরি করা যায়। অকেজো ডিপলিটার দ্বারা জমির জৈব সার এবং মাছের খাদ্য তৈরি হয়। মুরগির ঘরের মধ্যে লিটার ব্যবহার করলে এক ধরনের পোকা, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়। লিটারের কার্যকারিতায় এসব মারা যায় এবং পুণরায় জন্মে। এভাবে লিটারে আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মুরগি পা দিয়ে লিটার আঁচড়ায়, উল্টে-পাল্টে গোসল করে এবং লিটারে জন্মানো খাদ্য কুড়িয়ে খায়। এতে মুরগির স্বাস্থ্য থাকে ভালো।

সবশেষে বলতে হয়, আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালনে লিটার পদ্ধতি শ্রেয়। এতে উৎপাদন খরচ পড়ে কম পড়ে। এছাড়া প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোও হাতের কাছে পাওয়া যায়।