লেয়ার মুরগী পালন করার সঠিক পদ্ধতি

118

 

লেয়ার মুরগি হলো ডিম উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের মুরগি যাদেরকে একদিন বয়স থেকে পালন করা হয়, যারা ১৮ থেকে ১৯ সপ্তাহ বয়সে ডিম দিতে শুরু করে এবং উৎপাদনকাল ৭২ থেকে ৭৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত স্হায়ী হয়। ডিম উৎপাদনকালীন সময়ে এরা গড়ে প্রায় সোয়া দু’কেজি খাবার খেয়ে এক কেজি ডিম উৎপাদন করে।

হাইব্রিড লেয়ার ডিম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কাঙিখত বশিষ্ট্য বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন ধরনের মোরগ-মুরগির মিলন ঘটিয়ে ক্রমাগত ছাঁটাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ গবেষণার পর সৃষ্ট অধিক ডিম পাড়া মুরগিকে হাইব্রিড লেয়ার বলে।

লেয়ার জাতের নাম

ডিমের প্রকৃতি বা রং অনুসারে লেয়ার মুরগি দুই ধরনের:
(ক) সাদা ডিম উৎপাদনকারী:

এরা তুলনামূলক ভাবে আকারে ছোট। তুলনামূলকভাবে কম খাদ্য খায়, ডিমের খোসার রং সাদা। যেমন: ইসা হোয়াইট, লোহম্যান হোয়াইট, নিকচিক, ব্যবকক-বিভি-৩০০, হাবার্ড হোয়াইট, হাই সেক্স হোয়াইট, শেভার হোয়াইট, হাইলাইন হোয়াইট, বোভান্স হোয়াইট।

(খ) বাদামী ডিম উৎপাদনকারী:
তুলনামূলকভাবে আকারে বড়, খাদ্য বেশি খায়, ডিমের আকার বড়, ডিমের খোসার রং বাদামী। যেমন: ইসা ব্রাউন, হাই সেক্স ব্রাউন, শেভার ৫৭৯, লোহম্যান ব্রাউন, হাই লাইন ব্রাউন, ব্যবকক-বিভি-৩৮০, গোল্ড লাইন, ব্যবলোনা টেট্রা, ব্যবালোনা হারকো, হাবার্ড ব্রাউন।

লেয়ার মুরগি নির্বাচন
১. লেয়ারের জন্য সঠিকভাবে ভাল উৎপাদনশীল স্ট্রেইন নির্বাচন করতে হবে। কারণ সব মুরগি সমান ডিম দেয় না;
২. গুণগতমানের লেয়ার বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে;
৩. কাঙিখত বৈশিষ্ট্যের সুনাম রয়েছে এমন বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে;
৪. সুনাম রয়েছে এমন হ্যাচারী থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।

বাচ্চা খামারে আসার পরের কাজ
জন্মের প্রথম সপ্তাহে পরিবহনজনিত কারণে বাচ্চা পানি শূন্যতায় ক্লান্ত হয়। তাই এদের জন্য ব্রুডার ঘরে পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্হা করতে হবে এবং দ্রুত পানি পান করা শেখাতে হবে। পানির সাথে শতকরা ৫ ভাগ হারে গ্লুকোজ মিশিয়ে দিলে সহজে এরা সেখান থেকে শক্তি পেতে পারে। একইসাথে যে কোন উন্নমানের মাল্টিভিটামিন ও ইলেক্ট্রোলাইট প্রস্তুতকারী কোম্পানীর নির্দেশ মতো পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। দূরের হ্যাচারী বা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বাচ্চা পরিবহন করে খামারে আনলে মাল্টিভিটামিন ও ইলেক্ট্রোলাইট ব্যবহার করা হলে পরিবহনজনিত ক্লান্তি ও পানি শূণ্যতা দূর করে বাচ্চাকে দ্রুত স্বাভাবিক করে তোলে।

টিকা প্রদান ও তার গুরুত্ব
টিকা প্রদান কর্মসূচি অনুসারে বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদান করলে
১. শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি সৃষ্টি হয় এবং
২. সংক্রামক রোগ হতে মুরগিকে রক্ষা করা যায়। টিকাদান ফলপ্রসূ হলে রোগের প্রাদুর্ভাব খুব কম হবে এবং মৃত্যুর হার সহনীয় পর্যায় রাখা যাবে।

লেয়ার মুরগির টিকা
মারেক্স, রাণীক্ষেত, গামবোরো, ব্রংকাইটিস, বসন্ত, সালমোনেলা, করাইজা

ব্রয়লার মুরগির টিকা
মারেক্স, রাণীক্ষেত, গামবোরো

টিকা প্রদানের পূর্বে সতর্কতা
১. মুরগি ধরার সময় যত্ন সহকারে ধরতে হবে;২. মুরগির যে কোন ধরনের ধকল মুক্ত অবস্হায় টিকা প্রয়োগ করতে হবে;
৩. অসুস্হ মুরগিকে টিকা দেয়া যাবে না;
৪. টিকা প্রদান উপকরণ ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে;
৫. আবহাওয়া যখন ঠান্ডা সেসময়ে টিকা প্রদান করতে হবে।

টিকা ব্যবহারের সাধারণ নিয়মাবলী
প্রতিষেধক টিকা সবসময়ই সুস্হ পাখিকে প্রয়োগ করতে হয়:

বাড়ন্ত লেয়ার বাচ্চা পালন পদ্ধতি
৪ থেকে ৫ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করা পূর্ব পর্যন্ত বাড়ন্ত বাচ্চা হিসেবে ব্যবস্হাপনা করতে হয়;
ব্রুডিংয়ের পর খামারে মজুদের জন্য ভাল গুণাগুন সম্পন্ন পুলেট করা হয় যাতে ভবিষ্যতে বেশি ডিম পাওয়া যায়; ভাল ডিম উৎপাদনের জন্য পুলেট পালন ও নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাণিজ্যিক লেয়ার থেকে ডিম উৎপাদন
শতকরা ৫ ভাগ ডিম: বাণিজ্যিক পুলেট সাধারণত: ২০ সপ্তাহ বয়সের মধ্যে শতকরা ৫টি ডিম পাড়ে।
শতকরা ১০ ভাগ ডিম: ২১ সপ্তাহ বয়সে শতকরা ১০টি ডিম পাড়ে।

সর্বোচ্চ সংখ্যক ডিম উৎপাদন: ২৬ সপ্তাহ থেকে ৩০ সপ্তাহের সর্বোচ্চ সংখ্যক ডিম পাড়ে। অবশ্য বয়সের বিষয়টি ষ্ট্রেইন ভেদে তারতম্য হতে পারে। সর্বোচ্চ সংখ্যক ডিম পাড়তে শুরু করার পর কিছুদিন স্হিতিশীল থাকে এবং পরবর্তী সময়ে ডিম উৎপাদনের হার খুবই আস্তে আস্তে কমতে থাকে।

ডিমের স্হিতিশীল পর্যায়: ডিম উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে ডিমের আকার বড় হতে থাকে এবং ৪০ সপ্তাহ বয়সের পর মুরগির ওজন বৃদ্ধি স্হিতিশীল হয় এবং ৫০ সপ্তাহ বয়সের পর ডিমের ওজন স্হিতিশীল পর্যায়ে আসে।

বাড়ন্ত মুরগি পালন পদ্ধতি ও এগুলোর সুবিধা-অসুবিধা

অল-ইন অল-আউট পদ্ধতি:

খামারে এক ব্যাচ বাচ্চা পালন করে ডিম উৎপাদন শুরু পর্যন্ত আর কোন বয়সের বাচ্চা পালন করা হয় না। প্রতি ব্যাচ বাচ্চা পালনের পর পরবর্তী ব্যাচ বাচ্চা পালনের পূর্বে হাতে অনেক সময় থাকে।

সুবিধা
1. ঘর পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত ও সংস্কার করা যায়;
2. খামারে একই সাথে বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা না থাকায় পরষ্পরের মধ্যে রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে না।

অসুবিধা
1. ডিম উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না;
2. স্হানের অপচয় হয়।

মালটিপল রিয়ারিং পদ্ধতি
খামারে একই সাথে বিভিন্ন শেডে বিভিন্ন বয়সের মুরগি পালন করা হয়। যেমন-
১) ব্রুডার শেডে বাচ্চা
২) গ্রোয়ার শেডে বাড়ন্ত বাচ্চা ও পুলেট
৩) লেয়ার শেডে ডিম পাড়া মুরগি

সুবিধা
1. খামার সম্প্রসারণ ও ডিম উৎপাদনের ধারাবহিকতা বজায় থাকে:
2. বিভিন্ন বয়সের মুরগি পালন করা যায়।

অসুবিধা
1. বিভিন্ন বয়সের মুরগি থাকায় রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা বেশি থাকে;
2. প্রতি ব্যাচ মুরগি পালন শেষে শেড সম্পূর্ণরুপে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব হয় না।

আইসোলেশন রিয়ারিং পদ্ধতি
ব্রুডারে বাচ্চা প্রতিপালনের পর স্বতন্ত্র গ্রোয়ার শেডে স্হানান্তর করা হয়।

সুবিধা
1. রোগ-জীবাণুর বিস্তার কম হয়;
2. স্বতন্ত্র ব্রুডার ঘর ব্যবহারের ফলে কম খরচে বাচ্চা ব্রুডিং করা যায়।

অসুবিধা
রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা কম থাকলেও বাচ্চা স্হানান্তরের সময় কিছুটা ধকল সৃষ্টি হয়।

সিজনাল রিয়ারিং পদ্ধতি
সিজন বা মৌসুমের উপর নির্ভর করে বাচ্চা পালন করা হয়। সিজনাল বাচ্চা এমন সময় উৎপাদন করা হয় যেন বাড়ন্ত পুলেট পর্যাপ্ত আলো পেয়ে থাকে। সাধারণত: ৮ সপ্তাহ বয়স থেকে ১৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পুলেটের ঘরে ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা আলো প্রয়োজন। সিজনাল রিয়ারিং এমন সময় করা হয় যেন বাচ্চার বাড়ন্ত বয়স ডিসেম্বর মাস হয়।ড়

সুবিধা
1. সিজনাল বা মৌসুমী বাচ্চা অনেক বেশী উৎপাদনশীল থাকে;
2. প্রাকৃতিক আলোর সাহায্যে বাচ্চা উৎপাদন করা হয় বলে উৎপাদন খরচ কম হয়।

অসুবিধা
1. বছরে পুলেট উৎপাদন মাত্র একবার করা যায়।

ঠোঁট কর্তনের গুরুত্ব ও পদ্ধতি

মুরগির ঠুকরা-ঠুকরি বন্ধ করা;
খাদ্য অপচয় রোধ করা;
বাচ্চা মুরগির ৮ থেকে ১০ দিন বয়সে ঠোঁট কর্তন করা;
বাড়ন্ত বাচ্চার ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ বয়সে ঠোঁট কর্তন করা;
বাচ্চার নাকের ০.২ সেমি এবং বাড়ন্ত মুরগির ০.৪৫ সেমি সম্মুখে উপরে ঠোঁট কাটা;
উভয় ঠোঁট আলাদা কাটতে হয়;
ঠোঁট কাটার জন্য – ক) ব্লক চিক ট্রিমিং মেশিন, খ) হাই স্পিড ট্রিমিং মেশিন (গ) ডিবিকার ব্যবহার করা হয়।

কখন ঠোঁট কাটা উচিত নয়

ভ্যাকসিন প্রদানের দুই দিন আগে বা পরে বা ভ্যাকসিন প্রদানের দিন বা ঐ দিন;
সালফার জাতীয় ঔষধ সেবনের দুই দিন আগে বা পরে;
মুরগির ধকল সৃষ্টি হলে;
আবহাওয়ার পরিবর্তন বেশি হলে;
মুরগি ডিম পাড়তে শুরু করলে।
ঠোঁট কাটার সময় সতর্কতা
ঠোঁট কাটার দুই থেকে তিন দিন পূর্ব থেকে পানিতে মিশিয়ে ভিটামিন ‘কে’ খাওয়ানো এবং কাটার পর অন্তত এক থেকে দুই দিন তা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা;
ঠোঁট কাটার যন্ত্র ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করা;
ব্লেডের ধার ও তাপমাত্রা পরীক্ষা করা;
মুরগির চোখের এবং জিহ্বার যেন কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা;
দিনের মধ্যে ঠান্ডা সময়ে ঠোঁট কাটা;
অভিজ্ঞ টেশনিশিয়ান দিয়ে ঠোঁট কাটা।

ঠোঁট কাটার পরবর্তী পরিচর্যা

গভীর পাত্রে পানি সরবরাহ করা;
খাদ্যের সাথে সামান্য অতিরিক্ত আমিষ ব্যবহার করা।

বাড়ন্ত মুরগির খাদ্য ব্যবস্হাপনা

ডিম উৎপাদন শুরু হওয়ার ২ সপ্তাহ আগে থেকে খাদ্যের শতকরা ২ ভাগ ক্যালশিয়াম ব্যবহার করা উচিত;
ওজন কাঙিখত না হলে সর্বাধিক ৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত স্টার্টার রেশন প্রদান করা যায়;
পরবর্তীতে ১৮ সপ্তাহ পর্যন্ত ২ ধাপ বা ৩ ধাপে খাদ্য প্রদান;
ডিম উৎপাদন শুরুর পর ৪ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত দ্রুত খাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে
বয়সের পরিবর্তে ওজন অনুসারে খাদ্য প্রদান;
ডিম পাড়ার সময় ওজন বেশি হলেও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

পানি ব্যবস্হাপনা

পানি খাওয়ার পরিমানের উপর মুরগির স্বাস্হ্য নির্ভর করে;
পানি বিশুদ্ধ করার জন্য প্রতি লিটার পানিতে ০.৩ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার মিশাতে হয়;
পানির পাত্রের জন্য নির্ধারিত স্হান নির্বাচন করতে হয়;
গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত গরমের সময় ঘন ঘন ঠান্ডা পানি সরবরাহ করতে হয়।

পুলেটের ওজন বৃদ্ধির কুফল

বাণিজ্যিক ভাল ব্যবস্হাপনায় মুরগি ১৮ থেকে ১৯ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে;
ওজন বেশি হলে চর্বি জমে ডিম পাড়া কমে যেতে পারে;
ডিমের আকার ছোট হয়;
ফ্লকের মধ্যে সমতার অভাব হয়।

পুলেটের ওজন কমার কুফল

নিদ্ধারিত সময়ের পরে ডিম পাড়ে;
মুরগি দূর্বল হয় ও মৃত্যুহার বেশি হয়;
ডিম উৎপাদন হার কম হয়;
বয়স অনুসারে ফ্লকের সমতা থাকে না।

পুলেটের ওজন নিয়ন্ত্রণ
পুলেটের ওজন কম-বেশি হলে খাদ্যের পরিমাণ, খাদ্যে আমিষের হার কম-বেশি করে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

পুলেটের আলোক ব্যবস্হাআলোর কাল ও তীব্রতা বেশি হলে
মুরগি কম বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে;
ডিম পাড়ার সময় বেশি হয় না;
ডিমের আকার ছোট হয়;
খোলা ঘরে বাড়ন্ত মুরগির ঘরে রাত্রিকালীন আলো প্রদান ক্ষতিকর এবং দিনের প্রাকৃতিক আলোই যথেষ্ট।

গুণগত মান সম্পন্ন পুলেটের বৈশিষ্ট্য
1. দেহ সুগঠিত
2. পালকে পরিপূর্ণ
3. সঠিক ওজন
4. পারষ্পারিক দৈহিক সমতা বিশিষ্ট
5. উজ্জ্বল ঝুটি
6. উজ্জ্বল চক্ষু
7. সাদা চঞ্চল

সঠিক ওজন বৃদ্ধি ব্যবস্হাপনা
১) বয়স ও জাত অনুসারে খাদ্য প্রদানের মাধ্যমে সঠিক ওজন বৃদ্ধি করা যায়;
২) খাদ্যে প্রয়োজনমতো ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন, এ্যামাইনো এসিড ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ ব্যবহার করতে হবে;
৩. পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ব্লিচিং পাউডার বা ক্লোরিন ব্যবহার করতে হবে।