দেশে গত কয়েক বছরে জমি আবাদে যন্ত্রের ব্যবহার বেশ বেড়েছে। বর্তমানে ৯৫ শতাংশ জমিতেই যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। তা সত্ত্বেও সেভাবে বাড়ছে না শস্য খাতে প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সবচেয়ে খারাপ প্রবৃদ্ধি এখন কৃষি খাতের শস্য ও শাকসবজি উপখাতে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শস্যে প্রবৃদ্ধি দশমিক ৮৮ শতাংশে নেমে আসার পর থেকে এখনো তা ১ শতাংশে উন্নীত করা যায়নি। শস্যে প্রবৃদ্ধি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হয়েছে দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি ছিল দশমিক ৯৮ শতাংশ।
প্রায় এক দশক আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে শস্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যদিও এখনকার মতো যন্ত্রের ব্যবহার তখন ছিল না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে এখন ৯৫ শতাংশ জমির আবাদ হচ্ছে যন্ত্রে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল ৯০ শতাংশ। গত এক দশকেই সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে জমি আবাদে। এ কাজে দেশে এখন প্রায় ৩৫ হাজার ট্রাক্টর, সাত লাখ পাওয়ার টিলার, এক হাজার কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা হচ্ছে।
যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ার পরও শস্য খাতে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি না হওয়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে বলে মনে করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক। তিনি বলেন, কৃষকবান্ধব সরকারের গৃহীত নানা উদ্যোগ ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল বাজার ব্যবস্থার কারণে গতি পাচ্ছে না। এতে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারাও। শস্য খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বাজার ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াজাত ও ভ্যালু চেইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। জোর দিতে হবে গবেষণা ও সম্প্রসারণে। সর্বোপরি উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষককে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
গত কয়েক দশকের ব্যবধানে কৃষিতে বেড়েছে শ্রমিক সংকট। আবার ধারাবাহিকভাবে কমছে কৃষিজমি। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শস্য আবাদে বাড়ছে ঝুঁকি। হঠাৎ বন্যা কিংবা খরার কথা মাথায় রেখে সময়মতো জমি প্রস্তুত করতে হচ্ছে কৃষককে। এজন্য যন্ত্রের ব্যবহারও বাড়ছে। এছাড়া কৃষকের গড় বয়স এখন ৩৫ থেকে ৪৫ বছরে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় কৃষিকে টিকিয়ে রেখেছে যন্ত্র। আবাদে যন্ত্র না থাকলে পরিণতি আরো ভয়াবহ হতে পারত বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে দ্য মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাদিদ জামিল বণিক বার্তাকে বলেন, যান্ত্রিকীকরণ বাদ দিয়ে এখন কৃষি নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। শ্রম সংকট মোকাবেলা ও সময় সাশ্রয়ের জন্য কৃষকের কাছে কৃষি যন্ত্রপাতি জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন। আবার কৃষি যন্ত্র না থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতো শস্যের। কৃষিতে যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার টেকসই করতে হলে এগুলোকে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি কৃষির সার্বিক যেসব খাতে এখনো যন্ত্রের ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি, সেখানেও ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে শস্য কাটা, মাড়াই, সেচ, শস্য বপন প্রক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে যান্ত্রিকীকরণ করা গেলে প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে।
কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন কাজ করছে, তেমনি সরকারিভাবেও দেয়া হচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধা। খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) পরিচালক শেখ মো. নাজিমউদ্দিন বলেন, জমি আবাদে আমাদের প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার হচ্ছে। যন্ত্রের ব্যবহারে আরো নতুন নতুন ক্ষেত্র বের করা হচ্ছে। চাষাবাদে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ও কম্বাইন হারভেস্টর উৎপাদন সময় ও খরচ বাঁচাতে অনেক বেশি কার্যকর। এজন্য কৃষির যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। এ কার্যক্রমে প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের আনা হচ্ছে। বেসরকারি খাতকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভূমিকা রাখতে কৃষিযন্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। সামনের দিনে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুফল আরো দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছেন তিনি।
জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলা করে জমি আবাদে সবচেয়ে কার্যকর পথই হচ্ছে যান্ত্রিকীকরণ। কারণ শ্রমিক সংকটের কারণে বোরো মৌসুমে যদি ধান লাগাতে দেরি হয়, তাহলে এপ্রিল-মের দিকে বৃষ্টিতে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যথাসময়ে আবাদ করা গেলে এ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। আবার আমন মৌসুমে অর্থাৎ আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে যখন আমন ধান লাগানো হয়, তখন সূর্যের আলো কমে যায়, ফলে ফলন কম হয়। ধান ঠিক সময়ে লাগালে ফসলটাও ভালোভাবে কাটা সম্ভব হবে। বীজ রোপণ ও বপন থেকে শুরু করে সব কাজ যদি দ্রুত করা সম্ভব হয়, তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে দেশের কৃষিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব বলে জানান এসিআই এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. ফা হ আনসারী।
তিনি বলেন, দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিতে অর্থায়ন বাধা দূর করতে হবে। ব্যাংকগুলো সরাসরি কৃষককে ঋণ না দিয়ে কোম্পানিগুলোকে ঋণ দিচ্ছে। সেখানে পরিবর্তন আনতে হবে। আবার সরকারের ভর্তুকি কার্যক্রমের একটি অংশ কৃষিযন্ত্রে দেয়ার সময়ও চলে এসেছে। সূত্র: বিবি
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন