ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। তার মধ্যে শীত ও গ্রীষ্ম এই দুই ঋতুর প্রভাব পোলট্রি শিল্পে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয় এবং পোলট্রি খামারিদের ভোগান্তির মধ্যে ফেলে। আর ঋতুভেদে বাংলাদেশে পোলট্রি খামার ব্যবস্থাপনায় তারতম্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়াও বর্ষাকালেও খামার ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে বৈচিত্র্যময়।
সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী পোলট্রি খামার পরিচালনা করতে পারলেই খামার হবে লাভজনক। মনে রাখা দরকার শুধুমাত্র চিকিত্সা করে পোলট্রি খামার লাভজনক পর্যায়ে রাখা সম্ভব নয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সময়োপযোগী পোলট্রি খামার ব্যাবস্থাপনা সংক্রান্ত সঠিক ধারণা ও জ্ঞান। অবশ্য পোলট্রি খামার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নানা দিক রয়েছে। সব বিষয়ে স্বল্প পরিসরে তা আজকের লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়।
আমার আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো শীতকালীন পোলট্রি খামার ব্যাবস্থাপনা ও পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব।
প্রথমত: শীতকালীন পোলট্রি খামার ব্যাবস্থাপনা কেমন হওয়া দরকার:
পরিবেশের তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার ধরণ অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব আংগীককে নিজের পোলট্রি খামার পরিচালনা করতে হবে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ খামারি অথবা অভিজ্ঞ পোলট্রি কনসালট্যান্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। শীতের তীব্রতা বেশি হলেও পোলট্রি খামারে অবশ্যই যথাযথ বায়ু প্রবাহের (ভেন্টিলেশন) ব্যাবস্থা করতে হবে। খামারে পলিথিন ব্যবহার না করলে ভালো। পাটের তৈরি চটের মাধ্যমে খামারের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। ব্রুডিং প্রিয়ডে বাচ্চার ঘনত্ব ঠিক রেখে ব্রুডিং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।শেডের পর্দা কখন কতোটুকু ফাঁকা বা বন্ধ রাখলে খামারের মুরগি সজীব থাকবে তা খামারিকে বুঝে নিতে হবে। খামারের অভ্যন্তরে এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা বুঝে খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। খামারকে পলিথিন দ্বারা ঘিরে বা আবদ্ধ রেখে খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না। তাই পোলট্রি খামার পরিচালনা করতে পলিথিনের পর্দা সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করা উচিত।
পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায়:
এমোনিয়া গ্যাস হলো ক্যামিকেল জাতীয় গ্যাস। যার ক্যামিকেলিক গঠন হলো NH3 এই এমোনিয়া গ্যাস অতি তীব্র ঝাঁঝাল উৎকট গন্ধযুক্ত গ্যাস। খামারে এমোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যাবে খামারের অভ্যন্তরে বা খামারের কাছাকাছি গেলেই। শ্বাস প্রশ্বাস নিলেই তীব্র উৎকট গন্ধযুক্ত ও ঝাঁঝাল গ্যাসের উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে; সেই সাথে চোখ জ্বলবে।
এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে খামারের মুরগির শ্বাসতন্ত্রে ক্ষতিসাধন করবে এবং চোখে পানি ঝড়বে এমনকি চোখে ক্ষত সৃষ্টি হবে।এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতায় মুরগি মাথা ও ঘাড় নড়াচড়া করতে পারে।এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতায় মুরগি পায়ের নখ দ্বারা চোখ চুলকাতে পরে।তখন চোখে ক্ষতের সৃষ্টি হবে এবং মুরগির চোখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমোনিয়া গ্যাস ফ্রেশ বাতাসের চেয়ে ভারী গ্যাস। তাই এমোনিয়া গ্যাস নিচে পরে থাকে অর্থাত্ লিটারের একটু উপরে; যা মুরগি ঠিক যে লেভেলে থাকে।
পোলট্রি খামারে কীভাবে এমোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়:
মুরগির বিষ্ঠা, উচ্ছিষ্ট পচা খাদ্য, পাত্রের পরে যাওয়া পানি, উপযুক্ত ভেন্টিলেশনের অভাব যা ব্যাকটেরিয়াল ফারমেন্টেশনের মাধ্যমে পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়। তাই খামারে ব্যবহৃত লিটার যতো বেশি ভেজা বা স্যাতস্যাতে হবে ততো বেশি ব্যাকটেরিয়াল ফারমেন্টেশনের মাধ্যমে পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে।
পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি পরিমাপ করার পদ্ধতি:
পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি পরিমাপ করার জন্য বিশেষ ধরনের স্ট্রিপ পেপার পাওয়া যায়। যা পোলট্রি লিটারের কাছাকাছি ধরলে হালকা করে ভীজে যাবে এবং স্ট্রিপের রং চেঞ্জ হতে থাকবে।খামারে যতো বেশি এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা হবে স্ট্রিপের রং ততো বেশি পরিবর্তন হবে।
পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব:
বাচ্চা মুরগির চোখে সমস্যা হবে। শ্বাসতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে অতি সহজেই মাইকোপ্লাজমোসিস, রাণী ক্ষেত রোগ, কলিব্যাসিলোসিস ও কক্সিডিওসিস রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাবে। ভ্যাকসিন সঠিকভাবে কাজ করবে না। মুরগির দৈহিক বৃদ্ধি কমে যাবে। খাদ্য খাওয়া কমে যাবে কিন্তু পানি গ্রহণের মাত্রা বেড়ে যাবে।ফলে লিটার আরো বেশি ভিজে যাবে।ডিম পাড়া মুরগির ডিম পাড়া কমে যাবে। গ্রোয়িং মুরগির পেটে পানি জমবে।খামারে এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে সংশ্লিষ্ট খামারে অক্সিজেন লেভেল কমে যাবে। খামারে কার্বন ডাই অক্সাইড,কার্বন মনো অক্সাইড এর মতো ক্ষতিকর গ্যাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাবে।
পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা কীভাবে কমানো সম্ভব:
১।উপযুক্ত বায়ুপ্রবাহ নিশ্চিত করা।
২।ব্রুডিং প্রিয়ডে বাচ্চার ঘনত্ব সঠিক রাখা।
৩।লিটারের পুরুত্ব ঠিক রাখা।
৪।লিটারের আর্দ্রতা সঠিক রাখা।
৫।পর্দা হিসেবে পলিথিন বর্জন করা।
৬। লিটার যাতে ভিজে না যায় কিংবা স্যাতস্যাতে না থাকে সে দিকে খেয়াল রাখা
৭। লিটার পানিতে ভিজে গেলে বা কেক আকৃতির হলে তা সরাসরি বাতিল করে দেয়া
৮। লিটারের পি এইচ ৭ এর নিচে রাখা
৯। লিটারের আদ্রর্তা ঠিক রাখতে ফিটকিরি বা এলাম ব্যবহার করা যেতে পারে। এলামের মাত্রা হতে হবে ১০%।এলাম
ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়াল ফারমেন্টেশন হ্রাস পাবে।
১১। লিটারের ময়েশ্চার ২১-২৫ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
১২। লিটারের ময়েশ্চার যখনই ৩০% এর বেশি হবে তখনই এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।তখন লিটারের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মুরগির বুকের মাংস ঝলসে যাবে।
পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি কীভাবে টের পাওয়া যাবে:
পোলট্রি খামারে এমোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি
১। ১০-১৫ পিপিএম হলে -ঝাঝাল কটু গন্ধ টের পাওয়া যাবে
২। ২৫-৩৫ পিপিএম হলে -চোখে ক্ষত সৃষ্টি হবে এবং নাক নড়াচড়া করতে থাকবে
৩। ৫০পিপিএম হলে -চোখে পানি ঝড়বে এবং চোখ ফুলে যাবে ;সেই সাথে চোখে ব্যথা অনুভব করবে
৪। ৭৫ পিপিএম হলে-মুরগি মাথা নড়াচড়া করতে থাকবে এবং অস্বস্তি বোধ করবে।
৫। ১০০পিপিএম হলে-খামারের মুরগি অল্প সময়ের জন্য সহ্য করবে;এরপর মারা যেতে পারে।
তাই পোলট্রি খামার পরিচালনা করতে এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে হলে সব পোলট্রি খামারিকে অতি
সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে সকল পোলট্রি খামারিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে খামারে যেন কোন অবস্থাতেই এমোনিয়া গ্যাসের তীব্রতা ৫০ পিপিএম এর সীমা অতিক্রম না করে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন