পোল্ট্রি শিল্পে অ্যামোনিয়া গ্যাস অতি পরিচিত একটি নাম। যারা মুরগী পালনের সাথে সর্ম্পকিত তারা সবাই এটা সম্পর্কে কম-বেশী জানেন। কিন্তু খামারী ভাইদের অনেকেরই অ্যামোনিয়া গ্যাসের উৎস, ক্ষতিকর প্রভাব এবং সমাধানের উপায় সম্বন্ধে সুবিন্যাস্ত ও সুসংগঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে, অনেক সমস্যায় পরতে হয়। আমাদের দেশে মুরগী পালনের জন্য সাধারণত দুই ধরণের হাঊজিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যথা ১. কন্ট্রোল হাঊজ ২. ওপেন হাঊজ। অ্যামোনিয়া গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব দুই ধরণের হাঊজিং পদ্ধতিতেই দেখা যায়। তবে শীতকালে কন্ট্রোল হাঊজে অ্যামোনিয়া গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব বেশী পরিলক্ষিত হয়।
অ্যামোনিয়া (NH3) কি?
অ্যামোনিয়া এক প্রকার গ্যাস যা নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ যৌগের ভাঙ্গনের ফলে উৎপন্ন হয়। অ্যামোনিয়া (NH3) সকল প্রাণীর বিষ্ঠার সাথে প্রচুর পরিমাণ উৎপন্ন হয়। ডেয়রী খামারে অ্যামোনিয়া উৎপাদনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশী। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে মুরগীর খামার। অ্যামোনিয়ার একটা স্বাভাবিক মাত্রা আছে, যা অতিক্রম করলেই তার ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
অ্যামোনিয়ার মাত্রা ও লক্ষণ সমূহ:
মাত্রা (পিপিএম) লক্ষণ সমূহ
০-১০ স্বাভাবিক মাত্রা
২০-৩০ অ্যামোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি অনুভব করা যায়
৫০ চোখ ও নাক জ্বালাপোড়া করে।
১০০ বাস নালী জ্বালাপোড়া করে চোখে খুব বেশী প্রদাহ হয়।
২৫০ ৩০-৬০ মিনিটের বেশী অবস্থান করা যায় না।
কিভাবে অ্যামোনিয়া (NH3) গ্যাস তৈরী হয়
অ্যামোনিয়া সরাসরি মুরগীর অন্ত্রে তৈরী হয় না। বিভিন্ন হজম প্রক্রিয়ায় যে নাইট্রোজেন তৈরী হয় তা মুরগীর পায়খানার সাথে ইউরিক এসিড হিসাবে বের হয়ে আসে। এর পর ব্যাকটিরিয়ার দ্বারা সিরিজ বিক্রিয়ার মাধ্যমে ইউরিক এসিড থেকে অ্যামোনিয়া তৈরী হয়।
ইনফ্লুয়েনসিং ফ্যাক্টরস:
অ্যামোনিয়া গ্যাস বছরের সব সময় একই মাত্রায় নিঃসরণ হয় না। কিছু ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে অ্যামোনিয়া নিঃসরণের মাত্রা বাড়ে-কমে। নিম্নে সেই উপাদানগুলো উল্লেখ করা হল:
(১)তাপমাত্রা, (২)আর্দ্রতা, (৩) PH
অ্যামোনিয়া (NH3) গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাবঃ
ফার্মের অ্যামোনিয়া (NH3) গ্যাস শুধু মুরগীর জন্যই ক্ষতিকর নয়। বরং শ্রমিকসহ আমাদের চারপাশের পরিবেশের উপর ও বিরুপ প্রভাব ফেলে। নিম্নে প্রবন্ধে শুধু মাত্র মুরগীর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো হলো:
(১) খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়,
(২) মুরগীর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,
(৩) ডিম উৎপাদন কমে যায়,
(৪) চামড়ায় প্রদাহ হয়
(৫) শ্বাসনালী ও ফুসফুসে ক্ষত হয় এবং কখনো কখনো ফুসফুসে পানি জমে,
(৬) চোখ জ্বালা পোড়া করে, খাদ্য নালীতেও প্রদাহ হয় এবং দীর্ঘদিনের স্থায়ীত্বের কারণে Ascitis হয়,
(৭) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে সাধারণ রোগে যেমন (E. coli Infection) মুরগী মরার হার বেড়ে যায়।
(৮) কিডনীর স্বাভাবিক কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে যায় যেমন নেফ্রাইটিজ, ইউরোলিথিয়াসিস হয়।
(৯) শ্বাসতন্ত্রীয় রোগসমূহ যেমন মাইকোপ্লাজমা, ব্রংকাইটিজ এর প্রার্দূভাব বেড়ে যায়।
কিভাবে ফার্মের ভিতর অ্যামোনিয়া (NH3) গ্যাস কমানো যায়?
মুরগীর স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য ফার্মের ভিতর অ্যামোনিয়া (NH3)গ্যাস কমানোর বিকল্প নাই। অ্যামোনিয়া (NH3) গ্যাস কমানোর ব্যবস্থা হল (NH3)-কে NH4+ এ রুপান্তরিত করা। বিভিন্ন ধরনের এসিডিফায়ার এজেন্ট রয়েছে যা মুরগীর লিটারের পিএইচ কে কমায়ে দেয়। এর ফলে (NH3) দ্রুত NH4+ আয়নে পরিনত হয় এবং এই মুক্ত NH4+ আয়ণ অন্য কোন উপাদানের সাথে যুক্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় যৌগ তৈরী করে, ফলে অ্যামোনিয়া (NH3) গ্যাস তৈরী হতে পারে না। কিন্তু এই সব এসিডিফায়িং এজেন্ট লিটারের PH কে অল্প সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রন করে। তাই দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থার জন্য নিম্নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত
(১) আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণঃ
লিটারের আর্দ্রতাকে নিয়ন্ত্রণ করে খুব সহজেই একজন খামারী অ্যামোনিয়া নিঃসরণের পরিমাণ কমাতে পারে। যে লিটারের আর্দ্রতা বেশী সেখান থেকে অ্যামোনিয়া নিঃসরণ বেশী হয়। গবেষণায় দেখা গেছে লিটার আর্দ্রতার সাথে অ্যামোনিয়া নিঃসরণের গভীর সর্ম্পক রয়েছে। সুতরাং
লিটার সর্বদাই শুকানো রাখা অবশ্যই করণীয়। লিটারকে শুকানো রাখার জন্য পানির পাত্রের ব্যবস্থা ভাল হওয়া দরকার। যাতে করে পানির পাত্র থেকে পানি লিটারের উপর না পরে।
বায়ু চলাচলের উপরও আদ্রুতা নির্ভর করে ফলে ভেনটিলেশন ব্যবস্থাও ভাল রাখতে হবে। অবশ্যই আদ্রতা ৭০% এর নিচে রাখতে হবে, তা না হলে লিটার দলা পেকে যাবে।
এছাড়া লিটার শুষ্ক রাখার জন্য মুরগীর বিষ্টার/ লিটারের উপর চুন এবং চুনের সাথে বিভিন্ন অ্যামোনিয়া কমানোর প্রডাক্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
(২) সুষম খাবার ব্যবস্থাপনাঃ
মুরগীর খাবারে সাধারনত প্রচুর পরিমাণে ক্রড প্রোটিন জাতীয় রেশন দেওযা হয়। (যেমন মিট ও বোন মিল, সয়াবিন মিল) এই ক্রড প্রোটিন থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড এবং অ্যামিনো এসিড থেকে মুক্ত নাইট্রোজেন যা ইউরিক এসিড হিসাবে পায়খানার সাথে বের হয়ে আসে। তাই মুরগীকে এমন রেশন সরবরাহ করতে হবে যাতে ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকে কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো এসিডের চাহিদা পূরণ হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৩%-৫% ক্রুড প্রোটিনের পরিমাণ কমালে অ্যামোনিয়া নিঃসরণের পরিমাণ ৬০% কমে যায়। এ ছাড়া ফিডকে এসিডিফাই করার জন্য খাবারের সাথে জিপসাম (CaSO4) অথবা ক্যালসিয়াম বেনজয়েন্ট অথবা এ ধরণের অন্য কিছু যোগ করা হয়। এতে করে যে বিষ্ঠা তৈরী হয় তা এসিডিক হওয়ার কারণে NH3-কে NH4+ আয়নে পরিণত করে। কোন কোন ভেটেরিনারী ঔষধ কোম্পানীর ফিড গ্রেড মেডিসিন লিটারে এমোনিয়া গ্যাস উৎপাদন প্রতিহত করতে ভাল কাজ করে।
৩) লিটার নিয়ন্ত্রণঃ
অ্যামোনিয়া NH3 গ্যাস কম হোক আর বেশী হোক পোল্ট্রি লিটারে তৈরী হবেই। তাই বাজারে বিভিন্ন ধরণের অ্যামোনিয়া অক্সিডাইজিং পাউডার পাওয়া যায় যাতে বিভিন্ন মাইক্রোঅরগানিজম থাকে। এই মাইক্রোঅরগানিজমগুলো তাদের বৃদ্ধির জন্য অ্যামোনিয়াকে ব্যবহার করে। এই মাইক্রোঅরগানিজমগুলো অ্যামোনিয়া অক্সিডাইজিং এনজাইম নিঃসরণ করে অ্যামোনিয়াকে অক্সিডাইজ করে হাইড্রোক্সি অ্যামিন এবং তারপর নাইট্রাইট তৈরী করে। এই নাইট্রাইট আবার জীবানু দ্বারা ভেঙ্গে নাইট্রেট তৈরী করে লিটারে থেকে যায়।
(৪) শীতকালীন ব্যবস্থাপনা:
শীতকালে অ্যামোনিয়া গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব দুই ধরণের হাঊজিং পদ্ধতিতেই দেখা যায়। সুতরাং শীতকালে অ্যামোনিয়া গ্যাস যাতে স্বাভাবিক নিয়ত্রণ মাত্রায় থাকে তার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবেঃ
ক) কুয়াশা যাতে সেডে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
খ) ড্রিংকার বা নিপল লাইন থেকে যাতে পানি না পরে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
গ) ওপেন হাউজকে রাতে সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ রাখা যাবে না।
ঘ) কন্ট্রোল হাউজে রাতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার প্রতি লক্ষ্য রেখে কমপক্ষে ২-৩ টি ফ্যান চালু রাখতে হবে।
ঙ) ইঊকা এক্সট্র্যাক্ট জাতীয় ঔষধ পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে অথবা লিটারে স্প্রে করা যেতে পারে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪সেপ্টেম্বর২০