শোল মাছের লাভজনক চাষের কলাকৌশল

176

দামি মাছ শোল চাষে খরচ তুলনামূলক কম। সব ধরনের দুর্যোগ কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ্য করতে পারে মাছটি। আজ এর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো

পুষ্টির পাশাপাশি আমিষের চাহিদাও পূরণ করতে হয়। আমাদের শরীরে আমিষের চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করে মাছ। তাছাড়া এটি আমাদের প্রিয় খাবারও বটে। আমাদের অনেকের পছন্দের তালিকায় কিন্তু রয়েছে শোল।

বাংলাদেশে প্রায় সব ধরনের মাছ চাষ হয়। কিন্তু শোল মাছের চাষ খুব একটা চোখে পড়ে না। বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ ছাড়া অনেকে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেন শোল। এর সঙ্গে জড়িতরা অর্থনৈতিকভাবে সফল হচ্ছেন।

মাছ চাষে বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করতে হয়। শোলও এর ব্যতিক্রম নয়। এ মাছ চাষেরও বিভিন্ন কৌশল রয়েছে। নিয়ম মেনে মাছটি চাষ করা হলে চাষি যেমন লাভবান হবেন, অন্যরাও চাষ করায় উৎসাহ পাবেন।

শোল সাধারণত নদীতে বেশি থাকে। এরা কর্দমাক্ত ও জলজ উদ্ভিদ রয়েছে এমন জলাশয়ে বাস করতে পছন্দ করে। এরা সাধারণত পানির তলদেশে থাকতে চায়। এসব বৈশিষ্ট্য নদীতে বিদ্যমান। তাই নদীতেই বেশি পাওয়া যায় শোল। তবে নদীতে এ মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। তাই পুকুরে শোল চাষ করা যেতে পারে। এজন্য পুকুরকে মাছটির চাষ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে। পুকুরে অবশ্যই কচুরিপানা কিংবা অন্য পাতা ছড়িয়ে দিতে হবে। সাধারণত এসব পাতায় গাঢাকা দিতে বেশ পছন্দ করে মাছটি। পুকুরটি যেন খালবিলের মতো হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

শোলের জন্য রেডি ফিড পদ্ধতিটি বেশ লাভজনক। এ পদ্ধতি অন্য মাছ চাষ ব্যবস্থাপনা থেকে ভিন্ন। বিশেষ করে এর খাদ্য ব্যবস্থাপনা অনেকটা ভিন্ন। আমরা জানি, শোল সাধারণত অন্য দেশি মাছ ও প্রাণিকণা খেয়ে জীবন ধারন করে। কিন্তু শোলের পোনা প্রথমেই এসব খাদ্য গ্রহণ করে না। তাদের জন্য ট্যাংকে করে এক ধরনের প্রাণিকণা চাষ করতে হবে। একেবারে শুরুতে এই খাদ্য দেওয়া হয়। এছাড়া নতুন অবস্থায় প্রতিদিন সকালে শোলের জন্য তেলাপিয়া সিদ্ধ করে এতে কাঁচা ডিম মিশিয়ে খাদ্য তৈরি করতে হবে। এভাবে দেড় মাস খাবার দিতে হবে। দেড় মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিদিন আনুমানিক ৫০০ গ্রাম মাছ সিদ্ধ করে শোল মাছের খাদ্য হিসেবে পুকুরে দিতে হয়।

পুকুরে হাঁস নামানো যাবে না। কেননা, শোলের খাবার হিসেবে যে ছোট মাছ কিংবা অন্য খাবার দেওয়া হয়, সেগুলো হাঁসেরও প্রিয়। এ কারণে কোনোভাবেই পুকুরে যেন হাঁস নামতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে।

পোনা উৎপাদন
বাংলাদেশে শোল মাছের চাষ তেমন একটা হয় না বলে এ মাছের পোনা পাওয়া দুঃসাধ্য। তাই প্রাকৃতিকভাবে পোনা উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে।

প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন বেশ সহজ। শোলের প্রজনন মৌসুম হচ্ছে বৈশাখ। এ মাসের প্রথমদিকে ডিম পাড়তে শুরু করে মাছটি। তাই বৈশাখের আগে পুকুর ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো অবস্থায় ২০ থেকে ২৫ দিন রাখতে হবে। তাহলে পুকুরের তলায় এক ধরনের ঘাস জন্মাবে। ঘাস একটু বড় হলে পানি দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে হবে পুকুরটি।

কয়েক মাসের মধ্যে ঘাসগুলো বড় হয়ে যাবে। পানির ওপর ভেসেও উঠবে। এ সময় কিছু কচুরিপানা দেওয়া যেতে পারে। তবে পরিমাণে যেন কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এ জলজ উদ্ভিদে ডিম পাড়ার জন্য বাসা তৈরি করে নেবে শোল। সাধারণত এরা বাসায় ডিম পারে।

ডিম ফুটে যে পোনা বের হয় তার দৈর্ঘ্য এক দশমিক ২৫ থেকে এক দশমিক পাঁচ মিমি হয়। ডিম থেকে পোনা বের হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী ও পুরুষ মাছ পাহারা দেয়। পোনা বের হওয়ার পর এরা ঝাঁক বেঁধে থাকা শুরু করে, একসঙ্গে চলাফেরা করে। বিপদের সম্মুখীন হলে পোনাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। বিপদ কেটে গেলে আবার একসঙ্গে মিলিত হয়। পোনাগুলো চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই থাকে।

বিচিত্র এর খাবার
বাণিজ্যিকভাবে শোলের চাষ চোখে পড়ে না বললে চলে। তাছাড়া মাছটি নিয়ে বিস্তর গবেষণাও হয়নি। মাছটির আবাসস্থল, খাবার প্রভৃতি সম্পর্কে তবু কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

খৈল বা কুঁড়া দিয়ে বানানো কোনো খাবার খায় না শোল। ছোট মাছ এদের প্রিয় একটি খাবার। অনেকের মতে, ছোট মাছই শোলের প্রধান খাদ্য। মজার বিষয়, শোলের পোনার প্রিয় খাদ্য শুঁটকির গুঁড়ো, বিশেষ করে চিংড়ির শুঁটকি। এ জন্য চিংড়ির শুঁটকি গুঁড়ো করে ভালোভাবে পিষিয়ে পুকুরে দেওয়া হয়। এভাবে ১৫ দিন খাওয়ানো হলে পোনাগুলো খুব দ্রুত লম্বা হয়। পোনাগুলো দুই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা হওয়ার পরে শুঁটকির গুঁড়া পরিবর্তন করে কার্প জাতীয় মাছের ধানিপোনা খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ছোট সাইজের ব্যাঙ বা ব্যাঙাচি দেওয়া যেতে পারে।

পোনাগুলো যখন বড় হয়ে উঠে তখন ছোট ছোট মাছ দিতে হয়। মরা কিংবা তাজাÑসব ধরনের মাছ এদের পছন্দ। ছোট জলজ পোকা-মাকড় বা কচি চারাগুলোও খেয়ে থাকে। পুকুরের যে কোনো দেশি মাছের পোনা খেয়ে সাবাড় করে দেয় শোল। এ জন্য একে রাক্ষুসে মাছও বলা হয়ে থাকে।
শোলকে সঠিক মাত্রায় খাবার না দিলে বড় মাছ ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলবে। ফলে মাছ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে না। খাবারে ৪৩ শতাংশ প্রোটিন ও উচ্চ অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল সমৃদ্ধ না হলে মাছ বাঁকা হয়ে যাবে।

রোগবালাই
শীতকালে প্রায় সব মাছেরই বিশেষ বিশেষ কিছু রোগ লক্ষ করা যায়। তেমনি শোল মাছও এ সময় রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। শোল মাছকে সাধারণত ক্ষত রোগে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ সময় তাদের বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া উচিত, না হলে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মরে যেতে পারে। এতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যাহত হবে। শোল মাছ রোগে আক্রান্ত হলে যে উপায়ে বুঝে নিতে হবে, তা হলো- আক্রান্ত মাছের গায়ে ক্ষত বা লাল লাল দাগ দেখা যাবে। এ সময় দাগের আকৃতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ক্ষত রোগ মূলত মাছের লেজে, পিঠে ও মুখের দিকে বেশি হতে দেখা যায়। লেজের অংশ খসে পড়তে দেখা যায়, মাছ ভারসাম্যহীনভাবে পানির ওপরে ভেসে থাকে। তবে এ রোগের প্রতিকারও সম্ভব।

পুকুরে চাষকৃত শোল মাছকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ১৫-২০ দিন পর পর জালে উঠিয়ে দেখতে হবে। আবার দেখা শেষ হয়ে গেলে যথানিয়মে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। এ সময় ক্ষত আক্রান্ত মাছ ধরা পড়লে তা দ্রুত আলাদা করে ফেলতে হবে। এরপর আক্রান্ত মাছগুলোকে ১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম লবণ মিশ্রিত পানিতে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে আবার পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। তাছাড়া এ রোগ যেহেতু শীতকালে হয়, তাই রোগ আক্রমণের আগেই আশ্বিন মাসের শেষে কিংবা কার্তিক মাসের প্রথমদিকে পুকুরে শতাংশ প্রতি এক কেজি পাথুরের চুন ও এক কেজি লবণ দিতে হবে। এতে শীত মৌসুমগুলোতে রোগের কবল থেকে কিছুটা মুক্ত থাকবে।

অনেক সময় শোল মাছের পুষ্টির অভাব দেখা যায়। ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’ এবং ‘কে’ এর অভাবে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই মাছকে দেওয়া খাবারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট ভিটামিন ও খনিজ লবণ মিশিয়ে দিতে হবে। তাহলে মাছের উন্নতি করা সম্ভব হবে।

পুষ্টিগুণ
# প্রতি ১০০ গ্রাম শোলে রয়েছে- ৯৪ গ্রাম ক্যালরি, এক দশমিক দুই গ্রাম প্রোটিন রয়েছে, শূন্য দশমিক পাঁচ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে, ক্যালসিয়াম রয়েছে ৯৫ মিলিগ্রাম, হাজার ৮০ মাইক্রোগ্রাম জিংক রয়েছে, চর্বি রয়েছে দুই দশমিক দুই গ্রাম, ১৪০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে ও ফসফরাস রয়েছে ২৯৮ মিলিগ্রাম।
# মাংসাশী বা রাক্ষুসে বা শিকারি মাছ নামে পরিচিত
# ছোট মাছ, ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, মশার শূককীট, পোকামাকড় এদের খাবার
# বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়
# পানি ছাড়া কয়েক মাস বেঁচে থাকতে পারে
# জলজ বাস্তুতন্ত্রে ভূমিকা রাখে শোল
# খেতে সুস্বাদু এ জিওল মাছটি
# মানবদেহের হাড় ও মাংসপেশি গঠনে সাহায্য করে
# রুচি বাড়ায়।