সফেদার চাষাবাদ পদ্ধতি

2840

সফেদা গাছ বহুবর্ষজীবী, চিরসবুজ। এর আদি নিবাস মেক্সিকোর দক্ষিণাংশ, মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চল। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মেক্সিকোতে এর ব্যাপক উৎপাদন হয়।সফেদা একটি বারোমাসি ফল। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে এ ফল জন্মে। তবে বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোয় এর চাষ অপেক্ষাকৃত বেশি। সফেদার ভালো ফলন পেতে চাইলে এর সঠিক চাষাবাদ সম্পর্কে জানতে হবে।

সফেদায় রয়েছে শ্বেতসার, খনিজ লবণ ও ক্যালসিয়াম।

ভেষজ গুণ: ফলের শীতল পানীয় বা শরবত জ্বর নাশক হিসেবে কাজ করে। ফলের খোসা শরীরের ত্বক ও রক্তনালী দৃঢ় করে রক্তক্ষরণ বন্ধে সাহায্য করে।

উপযুক্ত জমি ও মাটি: উঁচু নিকাশযুক্ত বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগি। তবে সেচের সুবিধাযুক্ত স্থান হলে সব ধরনের দোআঁশ মাটিতেও চাষ করা যাবে।

জাত পরিচিতি:

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত সফেদার মধ্যে রয়েছে বারি সফেদা-১, বারি সফেদা-২ ও বারি সফেদা-৩। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ সফেদা-১, বাউ সফেদা-২ ও বাউ সফেদা-৩ উল্লেখযোগ্য। দেশের সব জায়গায় এসব জাত চাষ করা যায়। জোড়া কলমের মাধ্যমে এ ফলের বংশবিস্তার করানো হয়। তাই কলমের মাধ্যমে উৎপাদিত রোগমুক্ত এক থেকে দেড় বছর বয়সি চারাকে রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

বারি সফেদা-১:
ফল দেখতে গোলাকার চেপ্টা। আকারে বেশ বড়। কম বেশি সারা বছরই ফল ধরে। প্রতিটি ফলের ওজন ৮০-৯০ গ্রাম। প্রধানত চট্টগ্রাম এলাকায় সফেদা ভাল জন্মে। তবে অন্যঅন্য এলকাতেও এর চাষ করা যায়।

বারি সফেদা-২:
এ জাতটি দেশের মধ্যাঞ্চল বিশেষ করে ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকায় ভাল হলেও দেশের অন্যান্য এলাকাতেও চাষ করা যায়। ফলের গড় ওজন ৭০-১০০ গ্রাম। পাকা ফলের শাঁস লালচে বাদামী বর্ণের মোলায়েম, খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু।

বারি সফেদা-৩:
জাতটি ২০০৯ সালে অবমুক্ত করা হয়। বছরে দুবার ফল ধরে। এটি উচ্চফলনশীল জাত। ফল গোলাকার ও মাঝারি আকারের। ওজন ১০০ থেকে ১১৫ গ্রামের মতো হয়ে থাকে। স্বাদ মিষ্টি। এর ফলন বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি হয়।

বাউ সফেদা-১:
জাতটি সারা বছরই কম-বেশি ফল দেয়। ফল ডিম্বাকার, কম বীজযুক্ত ও মিষ্টি। শাঁস চমৎকার। পুষ্টিগুণে ভরা ফলটি পাকতে ছয় থেকে আট মাস লাগে। প্রচুর ফল ধরে। ফলের ওজন ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম হয়ে থাকে। গাছ ঝোপালো আকৃতির হয়ে থাকে।

বাউ সফেদা-২:
এটি একটি নিয়মিত ফলধারণকারী জাত। জাতটি অনেকটা বাউ সফেদা-১-এর মতো। তবে এ জাতের শাখা-প্রশাখা ছাতার মতো নিচের দিকে ঝোলানো থাকে। ফল ছোট থেকে মাঝারি আকারের হয়। থোকায় থোকায় ফল ধরে। ফল ডিম্বাকার। ফলের চামড়া অত্যন্ত পাতলা ও সুগন্ধযুক্ত। ওজন ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম। শাঁস লাল-বাদামি, কোমল ও সুস্বাদু।

বাউ সফেদা-৩:
বাউ সফেদা-৩ জাতের শাখাগুলো চারদিকে পাতার বলয়ে আবৃত থাকে। এ জাতের ফল মাঝারি থেকে বড় আকারের হয়। ফল ডিম্বাকার ও নিচের দিকটা সুচালো। ফল অত্যন্ত মিষ্টি, শাঁস সুগন্ধযুক্ত ও কোমল।

বংশ বৃদ্ধি:

সফেদার বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে গাছ রোপণ করা যায়। এ গাছে ফল ধরতে ৭-৮ বছর লেগে যায়। চারা উৎপাদন করতে ২-১ দিন বীজ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর বেলে দো-আঁশ মাটি দেখে বীজ রোপণ করতে হয়। এছাড়া কলম চাষের মাধ্যমেও বংশ বৃদ্ধি করা যায়।

চারা রোপণ:

সফেদার চারা রোপণের উপযুক্ত সময় জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ, অর্থাৎ জুন থেকে জুলাই। বর্ষাকালের শেষেও চারা রোপণ করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

রোপণ পদ্ধতি:

সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা ষড়ভুজী পদ্ধতিতে চারা রোপণ করা যেতে পারে। রোপণের জন্য চারা থেকে চারা ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ছয় মিটার থাকা বাঞ্ছনীয়। এরপর ৭৫ সেন্টিমিটার বা দুই ফুট চওড়া ও দুই ফুট গভীর গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের মাটি গর্তের ওপরে একপাশে সপ্তাহ দুয়েক রেখে দিতে হবে। এতে গর্ত জীবাণুমুক্ত করার জন্য আলো-বাতাস প্রবেশে সুবিধা হবে। এরপর পাশে রেখে দেওয়া মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে নিতে হবে। এ সময় পানি ছিটিয়ে দেওয়া ভালো। এক দিন পর তৈরি করা চারা কিংবা নার্সারি থেকে সুস্থ ও নিরোগ চারা সংগ্রহ করে ভরাট করা গর্তের মাঝখানে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের শেষে পানি দিতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা:

প্রতি গর্তে গোবর ১৫ কেজি, টিএসপি সার ২৫০ গ্রাম, এমওপি সার ২৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা:

সফেদা গাছ খরা সহ্য করতে পারে, তবে বেশি খরার সময় প্রয়োজনীয় সেচ দিলে ফলন ভাল হয়।

ফল সংগ্রহ:

প্রায় সারা বছরই ফুল ধরে। সাধারণত ফাল্গ–ন থেকে অগ্রহায়ণ, অর্থাৎ মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। সফেদা পরিপক্ব হলে, অর্থাৎ ফল শক্ত হলে সংগ্রহ করা উচিত। ফল সংগ্রহের উপযোগী সময় হলে খোসায় কিছুটা কমলা রঙের আভা আসবে। এছাড়া ফলের ভেতরের বীজ কালো হলে বুঝতে হবে পরিপক্ব হয়েছে। এ সময় গাছ থেকে সংগ্রহ করে ঘরে রেখে পাকাতে হবে। বছরে এক হাজার থেকে তিন হাজার ফল পাওয়া যায়।

সম্পাদনায়ঃ মো: মাহফুজুর রহমান।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৬জুলাই২০