সবজি চাষে লাখপতি দুই তরুন

140

কলেজপড়ুয়া দুই বন্ধু আব্দুল হালিম ও ওসমান গণি। তারা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার দুর্গম সীমান্তবর্তী ১নং বাগান বাজার ইউনিয়নে প্রান্তিক গ্রাম চিকনেরখীলের বাসিন্দা। দুইজনেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত। তবে তাদের গল্পটা সমাজের অন্য সাধারণ যুবকদের মতো নয়। ২০২০ সালে কভিড সংক্রমণে যখন সব কিছু অচল হয়ে পড়ে, তখন কলেজ ছেড়ে নিজ গ্রামে ফেরেন তারা। অলস-অবসর সময় কাটানোর চিন্তা থেকে মাথায় আসে চাষাবাদের। দুই বন্ধু মিলে গ্রামের কিছু এক ফসলি জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন সবজি চাষ। সফলতার মুখ দেখে ধীরে ধীরে তারা গড়ে তুলেন ৫ একর জমিতে ‘রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্ম’ নামে দিগন্তজোড়া সবুজ সবজি ক্ষেত। লাউ, চিচিঙা, ঢ্যাঁড়শ, তিতাকরলা, কাঁকরোল, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি সবজি ছাড়াও আছে পেঁপে বাগান। তিন বিঘা লাউ ক্ষেতের মাচায় দুলছে লাউ আর লাউ। নাইচ গ্রিন জাতের বারোমাসি লাউয়ের ডগায় ডগায় ফুল আর ফল।

একরের পর একর জমিতে সারা বছর উৎপাদন করছেন নানা স্বাদের ফলমূল ও শাকসবজি। বছর শেষে লাখ টাকা আয় করে প্রমাণ করে দিচ্ছেন কৃষিও সম্ভাবনাময়ী শিল্প। জ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ দুই বন্ধু কৃষিকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। অল্প দিনেই তাদের সফলতার গল্প ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। যৌথ প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির প্রান্তিক পাহাড়াঞ্চলের শিক্ষিত দুই তরুণ উদ্যোক্তার রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্মটি এখন সারাদেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় আরও বেশ কয়েকজন মানুষের। কৃষি-সংশ্লিষ্ট দেশে-বিদেশের বিভিন্ন উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা তাদের স্বপ্ন প্রকল্পটি দেখে আসছেন এবং এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেরাও সফল হওয়ার চেষ্টা করছেন। কৃষি বিভাগের মাধ্যমে তাদের মডেল ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।

সম্প্রতি নিরাপদ সবজি উৎপাদনকারী সফল কৃষক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কৃষকের সম্মান-স্বীকৃতিও লাভ করেছেন তারা। চট্টগ্রাম জেলা পর্যায়েও তারা সম্মাননা পেয়েছেন। লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরি বা প্রবাসীর স্বপ্ন ছুঁড়ে ফেলে এখন তাদের চোখে শুধু মাঠভরা সবুজ সবজিক্ষেত তৈরি ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্য এবং মানুষকে নির্বিষ-নিরাপদ শাকসবজি খাওয়ানোই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও প্রচেষ্টার সংকল্প।

তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আব্দুল হালিম জানান, এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ টাকার লাউ বিক্রি হয়েছে। গাছে আছে প্রায় ১০ হাজার লাউ। দুই বিঘা চিচিঙা খেতে এ পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকার চিচিঙ্গা বিক্রি হয়েছে। দেড় বিঘা পেঁপে ক্ষেতের ৫০০ গাছে এ পর্যন্ত ১৫ টন পেঁপে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। গাছে আছে আরও প্রায় ১০ টন পেঁপে।

হালিম আরও জানান, তার প্রজেক্টে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় কাঁকরোল। ৭ বিঘা জমিতে গত বছর ৭০-৮০ টন কাঁকরোল উৎপাদন হয়। যা বিক্রি হয় প্রায় ১২ লাখ টাকা। এ বছর আরও বেশি উৎপাদনের আশা তাদের। আগামী মাসেই ফসল তোলা শুরু হবে। ফেনী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ক্ষেত থেকে সবজি কিনে নিয়ে যান। ফলে হাটবাজারে নিয়ে বেচাবিক্রি করতে হয় না।

জানা গেছে, রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্মে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য হলুদ পাতার ব্যবহার ও পেরোমোন জৈব পদ্ধতি এবং জৈব সার ব্যবহার করা হয়। এ দুটি বালাই দমন পদ্ধতির কারণে কীটনাশক ছাড়াই পোকামাকড় দমন করা সহজ হচ্ছে। জৈব পদ্ধতিতে খরচও কম। কৃষি বিভাগ থেকেই নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কলাকৌশল শেখানোসহ সব ধরনের পরামর্শ-সহায়তা দিচ্ছে।

অপর উদ্যোক্তা ওসমান গণি বলেন, এখন দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই উৎসুক লোকজন তাদের ফার্ম দেখতে আসেন। ‘জাতীয় সবজি মেলা-২০২২’ উপলক্ষে গত ২ মার্চ সেরা নিরাপদ সবজি উৎপাদনকারী কৃষক হিসেবে তারা শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর উৎসাহী লোকজন এবং সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও তাদের ফার্ম পরিদর্শনে আসছেন। অনেকে তাদের অনুপ্রেরণায় পরিকল্পিত সবজি উৎপাদন শুরু করেছেন।

এদিকে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে স্মল হোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্টের (এসএসিপি) আওতায় বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫০ জন কৃষক সম্প্রতি রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্ম পরিদর্শনে আসেন। কীটনাশক প্রয়োগ না করে জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপদ সবজি চাষের কলাকৌশল দেখে তারা উৎসাহী হোন।

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক নাসির উদ্দীন চৌধুরী বলেন, শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তার রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্মটি এখন হাতে-কলমের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কীটনাশক ছাড়াও যে জৈব পদ্ধতিতে বালাই দমন করে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা যায় কৃষকরা এখানে এসে শিখছেন। তিনি আরও বলেন, এ ফার্মের সফল তরুণ উদ্যোক্তাদের আরও বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানোর উদ্যোগ রয়েছে কৃষি বিভাগের।