নীলফামারী থেকে: সবজি বীজ উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন জেলা সদরের খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের শাহপাড়া গ্রামের কৃষকরা। সেই আয়ে ওই গ্রামের অনেকেই কিনছেন জায়গা-জমি। খড়ের ছাউনি বদলিয়ে নির্মাণ করেছেন টিনের ঘর। লেখাপড়া শেখাচ্ছেন সন্তানদের।
জেলা শহর থেকে নীলসাগর যাওয়ার সড়ক হয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। সে গ্রামের কৃষি জমিতে বিভিন্ন বীজ উৎপাদনে স্থাপিত সারি সারি নেট হাউজ চোখে পড়ে সকলের। মানসম্মত সবজি বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে এসব নেট হাউজে।
এলাকার কৃষকরা জানান, ওই নেট হাউজে আবাদ করা হয় বেগুণ বীজ। সঠিক মানের বীজ উৎপাদনের জন্য ওই হাউজের ব্যবস্থা। সাধারণ কৃষির চেয়ে খরচ বেশি বীজ উৎপাদনে, আয়ও কয়েকগুণ বেশি।
গ্রামের কৃষক মো. মোমিনুর রহমান জানান, বীজ ক্রয়ের নিশ্চয়তা দিয়েছেন লাল তীর কোম্পানি। সঠিক মানের বীজ উৎপাদনের জন্য কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে কোম্পানির লোকজন। বিভিন্ন জাতের বীজের আগাম মূল্য নির্ধারণ করে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। ওই কৃষকের কৃষি জমি সাড়ে তিন বিঘা। এর মধ্যে ধানের আবাদ করেন মাত্র ২২ শতক জমিতে। অবশিষ্ট জমি ব্যবহার করছেন বীজ উৎপদনের কাজে।
আগে রাজমিস্ত্রির পেশায় ছিলেন মোমিনুর। সে সময়ে অভাব অনটন লেগে থাকতো তার। ২০০৯ সালে এলাকার কৃষকদের বীজ উৎপাদনের আয় দেখে তিনিও নামেন এ কাজে। ওই বছর করলা বীজ উৎপাদন করে লাভবান হয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন, এখন আর অভাবে পড়তে হয় না, না খেয়েও থাকতে হয় না।
কৃষক মোমিনুর গত বছর ৩৫ শতক জমিতে করলা বীজ উৎপাদন করে ৪২ কেজি বীজ বিক্রি করে পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪০০ টাকা। বীজ উৎপাদনে তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি কেজি বীজ দুই হাজার ২০০ টাকা করে বিক্রি করেছেন তিনি। পাশাপাশি ওই বছর ২০ শতক জমিতে মিষ্টি কুমড়ার বীজ উৎপাদন করে পেয়েছেন ৩২ হাজার টাকা। এ জন্য খরচ হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা। এ কাজে যুক্ত থেকে গত নয় বছরে সংসারে এসেছেন স্বচ্ছলতা। খড়ের ছাউনি ফেলে নির্মাণ করেছেন টিনের ঘর। ৮০ হাজার টাকায় কিনেছেন সাত শতক জমি। সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করেছেন বড় মেয়ের বিয়েতে। অপর এক ছেলে এক মেয়েকে পড়াচ্ছেন স্কুলে।
এবারে বেগুন বীজ উৎপাদনের কাজে নেমেছেন ১৮ শতক জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন ৩৫ কেজি বীজ। এজন্য খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। নেট হাউজ তৈরিতেই তার খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। প্রথমবারের মতো ওই নেট হাউজ তৈরি করায় খরচ একটু বেশি। তবে ওই নেট হাউজের আয়ু অন্তত ১০ বছর। পরবর্তীতে বীজ উৎপানে কমে যাবে সে খরচ। প্রতি কেজি বীজ বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিন হাজার টাকা দরে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারে উৎপাদিত বেগুন বীজ থেকে পাবেন এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা।
মমিনুর বলেন, বীজ উৎপাদনের কাজে নেমে ভালোভাবে চলছি। এখন আর অভাব নেই আগের মতো। আয় থেকে প্রতিবছর সংসারের সকল চাহিদা পূরণ করে বাড়তি টাকা থাকে।
একইভাবে গ্রামের কৃষক হাফিজুল ইসলাম (৩৪) সাড়ে সাত শতক জমিতে বেগুন, পাঁচ শতকে টমেটো, এক বিঘায় করলা, ৪০ শতক জমিতে কুমড়া বীজ উৎপাদন করছেন। ২০০৮ সাল থেকে বীজ উৎপাদনের কাজে নিজেকে জড়িয়ে কিনেছেন জমি, বদলিছেন বাড়ির চেহারা, লেখাপড়া শেখাচ্ছেন ছেলে মেয়েদের।
হাফিজুল ইসলাম জানান, লাভ দেখে এলাকার কৃষকরা বীজ উৎপাদনের কাজে ঝুঁকে পড়ছেন। বর্তমানে গ্রামে বীজ উৎপাদনে কৃষকের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
বীজ উৎপাদন ও বিপণন কোম্পানি লাল তীরের নীলফামারী জেলা ব্যবস্থাপক নাসিরুল হক বলেন, ২০০৭ সাল থেকে এ জেলায় কৃষকদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল বেগুন, মরিচ ও টমেটো বীজ নেট হাউজ পদ্ধতিতে করতে হয়। করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, চিচিংগা, ঢেরস প্যাকেটের মাধ্যমে করা হয়। গোটা জেলায় চুক্তিবদ্ধ কৃষকের সংখ্যা ২৫০ জন। এর মধ্যে খোকশাবাড়ি ইউনিয়নে রয়েছেন ৫০ জন। সবজি বীজ চাষ করে ধানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি লাভ করছেন কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম বলেন, সবজি বীজ উৎপাদন উম্মুক্ত থাকায় কৃষি বিভাগের কোনো প্রত্যয়নের প্রয়োজন হয় না। ব্যবসায়িক কারণে কোম্পানিগুলো তাদের বীজের গুণগত মান ধরে রাখেন। বীজের কোম্পানিগুলোর তৎপরতায় কৃষকরা বীজ উৎপাদনে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠছেন, ভবিষ্যতে সরকার কৃষকদের সহযোগিতা দিলে এ অঞ্চলে বীজ উৎপাদন একটি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠবে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন