জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই গরুর দুধ পান করে। চা, কফি সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরিতে দুধের বিকল্প নেই। অতিথি আপ্যায়নে গরুর গোশত অপরিহার্য। গরুর চামড়া দিয়ে তৈরি হয় জুতা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারসামগ্রী। গোবর একটি উন্নতমানের জৈব সার। শুকনো গোবর ভালো মানের জ্বালানি।
গোবর ব্যবহার করে বায়োগ্যাস উৎপাদন করে জ্বালানি চাহিদাও বহুলাংশে লাঘব করা সম্ভব। গরুর হাড় পোলট্রি খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এমনকি গরুর নাড়িভুঁড়ি মজাদার স্যুপ তৈরিতে ব্যবহার হয়। আমাদের জীবনে গরু এবং এর দুধ অতি প্রয়োজনীয় হলেও গরু পালনে এবং দুধ উৎপাদনে আমরা একেবারেই পিছিয়ে আছি। আর এ বিষয়ে আমাদের তেমন কোনো উদ্যোগও নেই।
সে জন্য আমদানির মাধ্যমে গরুর গোশত এবং গরুর দুধের চাহিদা মেটাতে হয়। ভারত ও নেপাল থেকে এ দেশে গরু আসে। ভারত থেকে প্রতি বছর এ দেশে প্রায় ৩০ লাখ গরু আসে, যার দাম প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। অপর দিকে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্কসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে গুঁড়ো দুধ আমদানি করতে হয়। দুধ আমদানিতে প্রতি বছর প্রায় ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়।
২০১৪ সালে দেশে গরুর গোশতের চাহিদা ছিল ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টন। উৎপাদন হয়েছে ৪৫ লাখ দুই হাজার টন। ঘাটতি ২২ লাখ ১০ হাজার টন। অপর দিকে, গরুর দুধের চাহিদা ছিল এক কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার টন, উৎপাদিত হয়েছে ৬০ লাখ ৯ হাজার টন। ঘাটতি ৭৯ লাখ ৩০ হাজার টন। আর এ চাহিদা দিন দিনই বাড়ছে।
একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারেও গরুর গোশতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৫ সালে বিশে^ গরুর গোশত রফতানির পরিমাণ দাঁড়াবে এক কোটি দুই লাখ টন। আর গরুর গোশত রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান এখন এক নম্বরে। ২০১৪ সালে ভারত ১৪ লাখ ৪৬০ হাজার টন গরুর গোশত রফতানি করেছে, যার মূল্য ৩২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা।
২০১৫ সালে ভারতের গরুর গোশতের রফতানির পরিমাণ হবে ১৫ লাখ টন, যার মূল্য ৩৬ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। অথচ একটু সচেতনতা এবং উদ্যোগ নিলে আমরা এই সেক্টরে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুই কোটি ৮৬ লাখ গরু রয়েছে। একটি উদ্যোগ নিলে অতি সহজেই আমরা এই সংখ্যাকে দ্বিগুণ করতে পারি।
এসব গরুর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানায় আছে দুই কোটি ৮১ লাখ ১০ হাজার আর খামারপর্যায়ে আছে চার লাখ ১০ হাজার। খামারপর্যায়ে গরুর সংখ্যা একেবারেই কম। সুস্থ দেহ এবং মনের জন্য প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিন ২৫০ মিলিলিটার গরুর দুধ পান করা প্রয়োজন। আমরা বিভিন্নভাবে গরুর খামার গড়তে পারি। বর্তমানে যারা প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি, তারা এককভাবেই কয়েক শ’ এমনকি হাজার গরু নিয়ে গরুর খামার গড়তে পারেন। তারা এটাকে একটি শিল্প হিসেবে নিতে পারেন।
মিল্ক ভিটা, ব্র্যাক, প্রাণ, ফ্রেশ, আকিজ গ্রুপ, আফতাব গ্রুপ এবং রংপুর ডেইরিসহ অনেকে দুধের খামার করলেও তাদের উৎপাদিত ও সরবরাহকৃত তরল দুধের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পাশাপাশি প্রত্যেক পরিবার যদি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এক বা একাধিক দুধেল গাভী পালন করে তাহলে নিজ পরিবারের দুধের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত দুধ বিক্রি করে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।
একইভাবে প্রত্যেক পরিবার যদি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মোটাতাজাকরণের জন্য ষাঁড় বা বলদ পালন করে, তাহলে তা বিক্রি করে গোশতের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবারে আনবে বাড়তি আয়। এবার দলভিত্তিক গরুর খামার গড়ে তোলার জন্য একটি দিকনির্দেশনার কথা বলছি। এ জন্য প্রত্যেকটি গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় লোকজন মিলে প্রথমে একটি সমিতি করবে।
প্রথমে তারা একটি বড় আকারের ঘর তৈরি করবে, যেখানে অনেক গরুর থাকার ব্যবস্থা হবে। জমি লিজ নিয়ে ঘাস চাষের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে গরুর ঘাসের কোনো অভাব না হয়। সামর্থ্য অনুযায়ী গরু কেনা হবে। এর বাইরে বর্গা সিস্টেমে গরু সংগ্রহ করা হবে। এই ব্যবস্থায় সচ্ছল লোকেরা নির্দিষ্ট দামে একটি গরু কিনে তা একজন কৃষকের কাছে লালন পালনের দায়িত্ব দেয়।
লালন পালন শেষে গরুটি বিক্রি করলে যা লাভ হয়, সেই লাভের একটি অংশ দু’পক্ষের মাঝে নির্ধারিত অনুপাতে বণ্টন হয়। একই সাথে কেনা দামও গরু দাতা ফেরত পান। কিন্তু এই সিস্টেমের একটি সমস্যা হচ্ছে, যেসব কৃষক গরুটি লালন পালন করেন, সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতার কারণে সেই কৃষক দু-একটির বেশি গরু পালন করতে পারে না।
কারণ হচ্ছে এ দেশের বেশির ভাগ কৃষকই আর্থিকভাবে একেবারেই গরিব এবং ভূমিহীন। ফলে বেশিসংখ্যক গরু পালনের মতো জায়গা, ঘাসের জন্য জমি এবং গরুর অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর মতো টাকা তাদের নেই। এমনকি গরু লালন পালনের মতো আধুনিক জ্ঞানও এসব কৃষকের নেই।
ফলে সামর্থ্যরে অভাবে এসব কৃষক যেমন বর্গা ব্যবস্থায় বেশিসংখ্যক গরু পালন করতে পারেন না, ঠিক তেমনি প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে গরু পালন করে খুব বেশি লাভবানও হতে পারেন না। এ অবস্থায় এই বর্গা ব্যবস্থাকে আধুনিক আকার দিলে বেশিসংখ্যক গরু পালন করা যাবে এবং ব্যাপক আকারে গরুর খামার প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
আর এই ব্যবস্থায় সামর্থ্যবান লোকেরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী গরু কিনে সমবায় সমিতির খামারে গরু পালনের দায়িত্ব দেবে অর্থাৎ বর্গা দেবে। আর সমিতি নির্দিষ্ট চুক্তিতে এসব গরু লালন পালন করবে। অর্থাৎ এই সিস্টেমে সবাই এক জায়গায় গরু বর্গা দেবে। এই সিস্টেমের সুবিধা হচ্ছে, যেকোনো ব্যক্তি ইচ্ছে করলে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এক বা একাধিক গরু কিনে এই খামারে বর্গা দিতে পারে।
এমনকি বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীরাও তাদের সামর্থ্য এবং ইচ্ছানুযায়ী এই খামারে গরু বিনিয়োগ করতে পারে। ফলে খুব সহজেই কয়েক শ’ গরু জোগাড় হয়ে যাবে। সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিই ইচ্ছে করলে এই খামারে বর্গা সিস্টেমে গরু বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমানে ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ করতে পারবে এরকম লোকের সংখ্যা অনেক।
একজন রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, পোশাক শ্রমিক, স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী এমনকি একজন ছোট ব্যবসায়ী প্রত্যেকের কিন্তু ১৫-২০ হাজার টাকা সঞ্চয় আছে। অথচ এই টাকা দিয়ে তিনি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন না। তিনি হয়তো এই টাকা ঘরের আলমিরা অথবা মাটির ব্যাংকে জমা রাখেন।
প্রত্যেকটি গরুর যাবতীয় তথ্য যেমন গরুটির মালিক, এর কেনা দাম, কেনার তারিখ ইত্যাদি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে, ফলে স্বচ্ছতায় কোনো সমস্যা হবে না। আর কোনো কারণে যদি কোনো গরু মারা যায় তাহলে সমিতি গরুটির কেনা দাম মালিককে ফেরত দেবে। আর এই অর্থ জোগানোর জন্য প্রতিটি গরুর লভ্যাংশ থেকে একটি অংশ দিয়ে একটি তহবিল গড়ে তোলা হবে।
এ দিকে খামারে লালন পালনের পর গরুটি বিক্রি করে লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশের পর একজন ব্যক্তি নতুনভাবে আবার আরেকটি গরু কিনে খামারে বর্গা দিতে পারেন। অর্থাৎ এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে সবার আগে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এ দিকে কোনো ব্যক্তি যখন কয়েকটি গরু পালন করেন, তখন তার পক্ষে গরুর রোগব্যাধি নির্মূলের জন্য একজন পশুডাক্তার নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয় না।
কিন্তু সমবায় ভিত্তিতে কয়েক শ’ গরু নিয়ে একটি খামার প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে খামারের ব্যবস্থাপনায় স্থায়ীভাবে একজন পশুডাক্তার নিয়োগ দেয়া সম্ভব। আর তখন সার্বক্ষণিকভাবে গরু দেখভাল করা যাবে এবং গরুর রোগব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব হবে। ফলে কাক্সিত সাফল্য অর্জন সহজেই সম্ভব।
আর প্রত্যেকটি খামারের গোবর দিয়ে একটি করে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হবে এবং ঘরে ঘরে এই বায়োগ্যাস সরবরাহ করে জ্বালানি চাহিদা মিটবে। বাংলাদেশে বেকার যুবকের সংখ্যা বেশি। গ্রামে গ্রামে খামার প্রতিষ্ঠা করলে এসব বেকারকে সহজেই কাজে লাগানো যাবে। যুবকেরা তখন আর বোঝা থাকবে না বরং সম্পদে পরিণত হবে। গ্রামের অর্থনীতি গতিশীল হবে এবং শহরের ওপর চাপ কমবে।
সুতরাং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে হলে দেশজুড়ে গরুর খামার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। দেশজুড়ে গরুর খামার প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড বা তহবিল গঠনের জন্য আমি সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। গরুর প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের দাম যেমন কমাতে হবে, ঠিক তেমনি তা সহজলভ্য করতে হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ