সম্ভাবনাময় গুলশা মাছের চাষ

971

Untitled-1-1911171318

বাংলাদেশের জলজ সম্পদ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উৎস হলেও এখনও পর্যন্ত এই জলজ সম্পদকে যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে সুষম উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভবপর হয়নি। উন্মুক্ত জলাশয় প্রধানত ব্যবস্থাপনা নির্ভর সম্পদ হওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ের চেয়ে এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত চাষাবাদের বিষয়টিকে পূর্বে সেরুপ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে দেশের বদ্ধ জলাশয়সমূহ থেকে চাষাবাদের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা বর্দ্ধনশীল জনগোষ্ঠির মৎস্য চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। মুক্ত জলাশয় ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি তাই উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৎস্য উৎপাদনে গুরুত্বারোপ করা হলে খাদ্য সরবরাহ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। এ প্রেক্ষাপটে নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ একটি উৎসাহজনক প্রযুক্তি।

আমাদের দেশেও বিভিন্ন নদ-নদীতে খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষ হচ্ছে। কিন্তু দেশীয় প্রজাতির মাছ যেমন- পাবদা, গুলশা, মাগুর, শিং ইত্যাদি খাঁচায় চাষের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্র গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ শুরু করে। বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিক গবেষণার পর খাঁচায় বিলুপ্তপ্রায় গুলশা মাছ চাষের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। সহনশীল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভাসমান খাঁচায় উচ্চমূল্যের বিলুপ্তপ্রায় গুলশা মাছ চাষ করে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টির অভাব পূরণে উলে­খযোগ্য অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।

ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষের সুবিধা

 খাঁচায় অধিক ঘনত্বে গুলশা মাছ চাষ করে আশানুরুপ উৎপাদন পাওয়া সম্ভব
 গুলশা মাছ অক্সিজেন সংবেদনশীল হওয়ায় প্রবাহমান পানিতে এ মাছ সহজেই চাষ করা যায়
 নদীর পানিতে তাপমাত্রার তারতম্য খুব কম হয় বিধায় এ মাছের রোগ বালাই অপেক্ষাকৃত কম
 বাজারে এ মাছের চাহিদা বেশী হওয়ার কারণে বাজার মূল্য অন্য মাছের তুলনায় অনেক বেশী।

ভাসমান খাঁচা তৈরীর উপকরণ, প্রস্তুত ও স্থাপন

 খাঁচা তৈরীর জন্য ১.০ সেমি. ফাঁসের নটলেস পলিথিলিন জাল ও খাঁচার উপরিভাগ ঢাকার জন্য ৭.০-৭.৫ সেমি. ফাঁসের কডের জাল ব্যবহার করা উত্তম
 সাধারণত ১৮ (৩ী৩ী২) ঘনমিটার আকারের জালের খাঁচা গুলশা মাছ চাষের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের জালের খাঁচায় ব্যবস্থাপনা সহজতর হয়
 খাঁচার তলদেশ এবং চারপাশে খাঁচা তৈরীর জাল দিয়ে সেলাই করে আটকে দিতে হবে। অতঃপর উপরিতলে ঢাকনার জাল সেলাই করে দিতে হবে
 নদীতে খাঁচা স্থাপনের জন্য প্রথমে খাঁচার মাপের বাঁশের তৈরী ফ্রেম প্লাস্টিকের ড্রামের সাথে বেঁধে পানিতে স্থাপন করতে হবে
 খাঁচার চার কোনায় প্লাস্টিক রশির লুপ বেঁধে ফ্রেমের সাথে জাল পানিতে ঝুলিয়ে স্থাপন করতে হবে
 নদীর নির্দিষ্ট স্থানে খাঁচা সারিবদ্ধভাবে বিন্যাস করার পর চতুর্দিকে বাঁশের বেষ্টনী তৈরী করতে হবে
 খাঁচাগুলিকে দুইপাশে মোটা প্লাস্টিক রশি দ্বারা বেঁধে জলাশয়ের পাড় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে নোঙ্গরের সাহায্যে স্থাপন করতে হবে।

স্থান নির্বাচন

 ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষের জন্য কম ¯্রােতের ছোট বা বড় নদীর অংশবিশেষকে নির্বাচন করা যেতে পারে
 সারা বছর কমপক্ষে ৩-৪ মিটার পানির গভীরতা, দূষণমুক্ত পরিবেশে, স্বচ্ছ পানি, মাছ বাজারজাত করার সুবিধা এবং চুরি ডাকাতির প্রবণতা নেই বললেই চলে এমন স্থানে খাচা স্থাপন করতে হবে।

খাঁচায় পোনা মজুদকরণ

 খাঁচায় পোনা মজুদকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুস্থ সবল পোনা ও সঠিক মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ
 পোনা মজুদের ক্ষেত্রে পোনার ওজন গড়ে ২.৫-৩.০ গ্রাম হলে ভাল হয়
 খাঁচায় প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ৫০০ টি গুলশা মাছের সুস্থ সবল পোনা ৫-৬ মাস চাষ করে ভাল ফলন পাওয়া যায়
 খাঁচায় পোনা ছাড়ার পূর্বে ফিল্টার নেটের নার্সারী হাপায় পোনাগুলোকে অন্তত ১-১.৫ মাস লালন করে নিলে খাঁচায় পোনার মজুদের পরে মৃত্যুর হার কম হয়
 খাঁচায় পোনা মজুদের আগের দিন নার্সারী হাপায় পোনাকে খাবার দেয়া বন্ধ রাখতে হবে এবং মজুদকরণের ৬-৭ ঘন্টা পর অল্প অল্প করে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে।

খাঁচায় খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যা

 উম্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় অধিক মজুদ ঘনত্বে মাছ চাষ করা হয় বিধায় মাছের বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের ভুমিকা নেই বললেই চলে। এ কারণে বাহির হতে সরবরাহকৃত সম্পূরক খাদ্যের ওপর মাছের বৃদ্ধি নির্ভরশীল। তাই খাঁচায় মাছ চাষের জন্য খাদ্য নির্বাচন ও প্রয়োগ অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয়
 ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষের ক্ষেত্রে সম্পূরক খাদ্যে কমপক্ষে ৩০% আমিষ থাকা আবশ্যক
 নার্সারী অবস্থায় গুলশা মাছের পোনার দেহ ওজনের ১৫% হিসেবে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে
 চাষকালীন সময়ে ১ম দুই মাস ৮-১০%, পরবর্তী ২ মাস ৭-৮% এবং শেষ দুই মাস ৫% হিসেবে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে
 ফিডিং ট্রে ব্যবহার করার পরও সরবরাহকৃত খাদ্যের প্রায় শতকরা ৩০-৪০ ভাগ অপচয় হয় যা পানিতে পঁচে পানি দূষণ ও মাছের মড়কসহ আর্থিক ক্ষতি সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খাঁচায় ভাসমান পিলেট জাতীয় খাদ্য দৈনিক ২/৩ বার যতক্ষণ খাঁচার মাছ খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় ততক্ষণ পর্যন্তপ্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
 উন্মুক্ত জলাশয়ে অধিক ঘনত্বে খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে জলাশয়ের শেওলাসহ বিভিন্ন ধরণের কীটপতঙ্গ ও পরজীবি খাঁচার জালকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে গ্রহণ করে, যার ফলে জালের ফাঁস দিয়ে পানি প্রবাহ কমে যায়। ফলে খাঁচার মাছ বিভিন্ন প্রকার রোগসহ পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই খাঁচার তলদেশের অব্যবহৃত খাদ্য নিয়মিত পরিস্কার করে খাঁচার পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে
স্রোতে ভেসে আসা জলজ উদ্ভিদ/আগাছা যেন খাঁচার বাহিরে জমা হয়ে পানি প্রবাহ কমিয়ে না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ

 ন্যুনতম খরচে ও পরিশ্রমে যে কোন সময় খাঁচার মাছ আহরণ করা যায়
 মাছ একত্রে আহরণ অপেক্ষা ৪-৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ৬ মাস পর্যন্ত বেছে বেছে বড় মাছ আহরণ করলে অধিক লাভবান হওয়া যায়
 ভাসমান খাঁচায় গুলশা মাছ চাষ করে প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৯-১০ কেজি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।

দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে নদীতে খাঁচা স্থাপন করে বিলুপ্তপ্রায় গুলশা মাছ সহজে চাষ করা যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কিছু নদীতে উৎসাহী মৎস্য চাষীরা খাঁচায় মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। এর ধারাবাহিকতায় নদীতে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির গুলশা মাছ খাঁচায় চাষ করে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। ভাসমান খাঁচায় গুলশাসহ অন্যান্য দেশীয় মাছ চাষের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরিণ মুক্ত জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ