সরকারি চাকরি ছেড়ে কৃষিতে সফল এক কৃষকের নাম আহসান-উল হক বাবু। উপজেলায় পরিচিত হয়েছেন একজন আদর্শ কৃষক হিসেবে। নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের অসুরখাই গ্রামের ওই কৃষকের প্রচলিত কৃষির পাশাপাশি রয়েছে অতি প্রাচীন ফসলের বিভিন্ন জাত রক্ষার গবেষণা প্লট। গবেষণার অংশে তিনি এবারে আবাদ করেছেন পার্পল ভুট্টা।
প্রাচীন পেরুভিয়ান জাতের ওই ভুট্টার দানা গাঢ় জাম রংয়ের। তার গবেষণায় আরও স্থান পেয়েছে প্রাচীনকালের বিখ্যাত ‘খোরাসান’ গম। ‘রেইজ বেড ফেরো অ্যান্ড টুইন প্লানটেশন’ পদ্ধতিতে গমের আবাদ করে পেয়েছেন অতিমাত্রায় ফলন। এ ছাড়াও তার সফলতার ঝুড়িতে জমা হয়েছে দেশীয় বিলুপ্ত প্রায় ধান কাটারিভোগ, কালোজিরা, বালাম, লক্ষ্মীদিঘা, ধনিয়া, রাঁধুনিপাগল, সাহেব চিকন, কালাভাত ধানের আবাদ।
পাশাপাশি ড্রাগনসহ বিভিন্ন প্রজাতির জনপ্রিয় আম, মালটা, বিভিন্ন জাতের লিচু এবং অতিমাত্রায় উপকারী অ্যাভাকাডো, রামবুটান ফল ও কফির সফল চাষিও তিনি।ভিন্ন রঙের পার্পল ভুট্টার জাতটি অতি প্রাচীন এবং উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ। কৃষক বাবু জানান, সুস্বাদু ওই ভুট্টা খেতে রাজশাহীর বিখ্যাত পাকা ফজলি আমের সমতুল্য মিষ্টতাবিশিষ্ট (BRIX)। রঙিন ওই ভুট্টার মিষ্টতা ২০, আর পাকা ফজলি আমের মিষ্টতা ১৯।
বিখ্যাত খোরাসান গমের আবাদেও সফল: প্রাচীনকালের বিখ্যাত ‘খোরাসান’ জাতের গম আবাদেও সফল হয়েছেন তিনি। কানাডা থেকে আগত সিলেটের আব্দুল বাসিত সেলিমের কাছ থেকে খোরাসান গমের বীজ সংগ্রহ করেন কৃষক আহসান-উল- হক বাবু। এবারে পরীক্ষামূলক চাষ করে সফল হয়েছেন তিনি। বাবু বলেন, প্রাচীনকালের মূল্যবান খোরাসান গমের প্লটটি দৃষ্টিনন্দন রূপ ধারণ করেছিল।
মিষ্টিগন্ধি এই গমের আটার মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে যে কোনো গমের তুলনায় অনেক বেশি। মূলত জাপান এর প্রধান ক্রেতা। গত মৌসুমে আরও তিনটি উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন গমের জাতের গবেষণামূলক চাষ করেছিলাম আমি। এর মধ্যে একটি জাত উচ্চমাত্রায় জিংক সমৃদ্ধ। ফলন হয়েছে হেক্টর প্রতি ছয় টন। যা এযাবৎকালের রেকর্ড পরিমাণ ফলন।
অতিমাত্রায় পুষ্টি সমৃদ্ধ ড্রাগন চাষেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত: কৃষক আহসান-উল বাবু ড্রাগন চাষের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তার সাফল্যে উপজেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ওই ফলের চাষ। বাবু জানান, বিদেশি ড্রাগন ফলে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে। সেটি বিবেচনায় এনে কৃষি বিষয়ক ওয়েবসাইট থেকে চাষাবাদ সম্পর্কে অবগত হন তিনি। এরপর যশোহর জেলার চৌগাছা থেকে চারা সংগ্রহ করে এনে ২০১৬ সালে শুরু করেন ৬০ শতক জমিতে ড্রাগন চাষ।
বাবুর সফলতায় উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ছে ড্রাগন চাষ। লাভজনক হয়ে উঠেছে অনেকের বাগান। তাদের মধ্যে কামারপুকুর ইউনিয়নের পাকাতিপাড়া গ্রামের মো. রাশেদুজ্জামান মানিক ও মো. সাজেদুর রহমান লেবু, দক্ষিণ অসুরখাই গ্রামে মো. আব্দুর রাজ্জাক রয়েছেন।রাশেদুজ্জামান মানিক বলেন, গ্রামে ড্রাগনের বাগান দেখে আমিও আগ্রহী হই। আমার মতোই আগ্রহী হয়েছেন অনেকে।
কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম ধানে ম্যাজিক ফলন: রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম ধান বিলুপ্ত হতে চলেছে। একটি বিশেষ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে ওই ধানের ফলন বৃদ্ধিতেও সফল হয়েছেন কৃষক বাবু। আহসান উল হক বাবু জানান, ইন্টারনেটে কৃষি বিষয়ক ওয়েবসাইট থেকে ‘Raised bed Furrow & Twin plantation Teachnique’ পদ্ধতি খুঁজে পান তিনি।
সেটি নিয়ে বেশ কিছুদিন অধ্যয়ন করেন তিনি। পরবর্তীতে সে অনুযায়ী ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম জাতের ধান চাষাবাদের মনস্থির করেন। এ জন্য সিলেটের এবি কৃষি প্রকল্প নামের একটি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বিলুপ্ত জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করেন। তিনি জানান, বীজতলায় বীজ বপনের ১৪ দিনের মধ্যে তা জমিতে লাগানো হয়।
তিন জাতের ধানের চারা প্রথমে ৫৫ শতক নিজের জমিতে লাগান তিনি। এর মধ্যে কাটারিভোগ ১৫ শতক, কালিজিরা ১৫ শতক ও বালাম ২৫ শতক জমিতে। একটি করে ‘জধরংবফ নবফ ওপর সারিবদ্ধভাবে চারা লাগানো হয়েছে। বেডের সাইজ প্রস্থে ৩ ফুট। একটি সারি থেকে অপর সারির দূরত্ব এক দশমিক আট ফুট। চারা থেকে চারার দূরত্ব এক দশমিক তিন ফুট।
রেইজ বেডে লাগানো একটি চারার সর্বোচ্চ ১৫২টি কুশি বের হয়েছে। সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বেড়ের ফাঁকা জায়গা। ব্যবহৃত সারের মধ্যে ছিল বায়োগ্যাস স্লারি, খৈল, ভার্মি কম্পোট, হাড়ের গুঁড়া। এ ছাড়াও স্বল্প পরিমাণে প্রয়োগ করা হয় ডিএপি, এমওপি এবং ইউরিয়া সার। চারা রোপণের ১৪০ দিন থেকে ১৪৫ দিনের মধ্যে ধান কেটে ঘরে তোলেন।
কৃষক আহসান-উল হক বাবু জানান, তার মূল উদ্দেশ্য বিলুপ্ত জাতের ধান চাষাবাদ ফিরিয়ে আনা। আধুনিক এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে বেশি ফলনের পাশাপাশি বীজ সংরক্ষণ করে তা সাধারণ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। যাতে এ অঞ্চলের চাষিরা বিলুপ্ত প্রায় ধান চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এমন বীজ সংগ্রহে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সজীব সিডস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যার স্বত্বাধিকারী তিনি নিজে।
কে এই কৃষক আহসান উল হক বাবু: মরহুম পিতা তছির উদ্দিন সরকার পেশায় ছিলেন একজন সরকারি চাকরিজীবী। মাতা আছিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ওই দম্পতির চার ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট আহসান-উল- হক বাবু। বাবু ছোট বেলায় দেখেছিলেন বাবা চাকরিজীবী হলেও নিজের জমিতে আবাদ করতেন ডাল, জব, গম, সরিষা, ধান, আলু, রসুন, পিয়াজ, আদা, মরিচ।
এ ছাড়াও বাড়িতে পালন করতেন গাভী, চাষ করতেন মাছ। ওই সব চাষাবাদ ও লালনপালন করে পরিবারের চাহিদা মেটাতেন। এ থেকে কৃষির প্রতি দুর্বলতা ছিল তার ছোটবেলা থেকে। বাবু স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে চাকরি নেন। পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে কৃষিতে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে মৎস্য ও পশুপালনের ওপর তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন।
এরপর ১৯৯৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ধীন এটিডিপি প্রকল্পের আওতায় দানা ফসলের ওপর এক মাসের ভারতের হায়দরাবাদ, পুনে, মুম্বাইয়ে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও অন্যান্য বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তিভিত্তিক বীজ উৎপাদনকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
২০০০ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের নিবন্ধন পান। এরপর ২০০৩ সালে সজীব সিডস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ধান ও আলু বীজ উৎপাদন করে বাজারজাত করেন। স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মাঝে আলু বীজ সরবরাহে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসআইডির প্রাইজ প্রকল্পের আওতায় টিস্যু কালচার পদ্ধতির মাধ্যমে বীজ আলু উৎপাদনও করেন তিনি।
এমন কাজে যুক্ত হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন ঐহিত্যবাহী ও প্রাচীনতম বিলুপ্ত প্রায় ধান, গমসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ ও মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনার। এ ছাড়া তার বর্তমানে রয়েছে ড্রাগনবাগান, বিভিন্ন প্রজাতির জনপ্রিয় আম, মালটা, বোম্বাই, মাদ্রাজি, বেদানা, চায়না থ্রি জাতের লিচু ছাড়াও অ্যাভাকাডো, রামভুটান, কফি ইত্যাদি বিভিন্ন বিদেশি ফলের বাগান।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ