সাতক্ষীরায় ভাইরাসের সংক্রমণে পথে বসতে চলেছে চিংড়িচাষিরা

772

চিংড়ি

চলতি উৎপাদন মৌসুমে এখান থেকে মুনাফা তুলে নেয়ার প্রত্যাশা করছিলেন সাতক্ষীরার চিংড়িচাষিরা। উল্টো তাদের এখন পথে বসার উপক্রম হচ্ছে। ভাইরাসের সংক্রমণে চিংড়ির মড়ক দেখা দেয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।

একদিকে রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব, অন্যদিকে চিংড়ির দাম কমে যাওয়ায় তাদের এখন সর্বস্বান্ত হওয়ার দশা। জেলার ছোট-বড় চিংড়িচাষিরা কমবেশি সবাই এখন ভুক্তভোগী। আশঙ্কা করা হচ্ছে, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার ঘেরগুলোয় ১০০ কোটি টাকার বেশি দামের চিংড়ি মারা গেছে

দেশ থেকে রফতানি হওয়া চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদন হয় সাতক্ষীরা জেলায়। ‘সাদা স্বর্ণ’ নামে খ্যাত চিংড়ির চাষ হয় এখানকার ছয় উপজেলার প্রায় আধা লাখ হেক্টর জমিতে। এসব জমিতে গড়ে তোলা ঘেরগুলোয় মূলত বাগদা, গলদা ও হরিণা প্রজাতির চিংড়ির চাষ করা হয়। এর মধ্যে বাগদা ও গলদা রফতানি করা হয়। হরিণা চিংড়ি সরবরাহ করা হয়ে থাকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে। শুধু চিংড়ি রফতানি করেই দেশের অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা যোগ করছেন সাতক্ষীরার চিংড়িচাষিরা।

চলতি উৎপাদন মৌসুমেও এখান থেকে মুনাফা তুলে নেয়ার প্রত্যাশা করছিলেন সাতক্ষীরার চিংড়িচাষিরা। উল্টো তাদের এখন পথে বসার উপক্রম। ভাইরাসের সংক্রমণে চিংড়ির মড়ক দেখা দেয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।

এদিকে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘেরে পানিস্বল্পতা, পরিবেশসম্মত না হওয়া ও রেণু পোনা জীবাণুমুক্ত না হওয়ায় ভাইরাস দেখা দিচ্ছে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার সরাপপুর গ্রামের বিশিষ্ট চিংড়িচাষি রাজ্যেশ্বর দাশ জানান, ৩০-৩৫ বছর ধরে রফতানির জন্য চিংড়ি উৎপাদন করে আসছেন তিনি। চলতি মৌসুমেও তিনি প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। তবে গত এক দশক চিংড়ি চাষ করে এবারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি।

রাজ্যেশ্বর দাশ বলেন, চলতি বছর উৎপাদন শুরুর পর থেকেই চিংড়িতে ব্যাপক হারে মড়ক লাগে। রফতানি গ্রেডের কাছাকাছি আকৃতিতে আসতে না আসতেই চিংড়ি মরে ঘের সয়লাব হয়ে গেছে। শুধু এ কারণেই লোকসান হয়েছে অন্তত দুই কোটি টাকার বেশি। উপরন্তু পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন করে তুলেছে চিংড়ির দাম কমে যাওয়া। মৌসুমের শেষ দিকে এসে চিংড়ির ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়ছে।

বাংলাদেশ চিংড়িচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার আবুল কালাম বাবলা জানান, চলতি মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার বিঘার ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘেরের অধিকাংশ চিংড়ি মরে গেছে।

আবুল কালাম বাবলা আরো জানান, ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে চলতি মৌসুমে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে আরো প্রায় ১০০ বিঘা পরিমাণ পুকুরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও মড়ক লেগে সব চিংড়ি মরে গেছে। এতে ১ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে তার। চলতি মৌসুমে জেলার বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরে মড়ক লেগে যে পরিমাণ চিংড়ি মারা গেছে, তার মূল্য কমপক্ষে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকা।

ডাক্তার আবুল কালাম ও রাজ্যেশ্বরের মতো চিংড়ি চাষ করে এবার বেশ লোকসান দিয়েছেন জেলার চিংড়িচাষি সামছুর রহমান, গোল্ডেন হোসেন ও জালাল উদ্দিন। তারা জানান, তাদের প্রত্যেকেই কমবেশি চিংড়ি চাষ করেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাবে ঘেরের চিংড়ি মরে গেছে। এর মধ্যে সামছুর রহমানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা। একই অবস্থা চাষী জালাল ও গোল্ডেন হোসেনেরও।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আবদুর রব জানান, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন না চাষীরা। দুই মাস আগে যে চিংড়ি ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, তা এখন ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে চাষী ও প্রক্রিয়াজাতকারী ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এদিকে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৮ মৌসুমে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলার ৪৯ হাজার ১৬৩টি নিবন্ধিত ঘেরে রফতানির জন্য বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ২ হাজার ১০৫টি ঘের, তালায় ১ হাজার ২৯৫টিতে, দেবহাটায় ২ হাজার ৮২৯টিতে, আশাশুনিতে ১৩ হাজার ২১৭টিতে, কালিগঞ্জে ১৪ হাজার ৫৫৯টিতে ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫ হাজার ১৫৮টি ঘেরে রফতানির জন্য বাগদা চিংড়ি চাষ করেছিলেন চাষীরা। জেলায় এবার চিংড়ির উৎপাদন বাড়ার প্রত্যাশা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। সাতক্ষীরায় এবার চিংড়ির উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৭ হাজার ৫০০ টন, যেখানে গেল মৌসুমে এ উৎপাদন লক্ষ্য ছিল ২৬ হাজার টন।

বাংলাদেশ চিংড়িচাষি সমিতির সাবেক সভাপতি ডাক্তার আফতাবুজ্জামান জানান, দেশের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয় মূলত ১৯৭২ সালের দিকে। এর আগে এখানকার সাধারণ চাষীদের মধ্যে এ নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। ১৯৭২ সালের পর থেকে যখন পণ্যটি বিদেশে রফতানির চাহিদা বাড়তে লাগল, তখন থেকেই এ জেলার চাষীদের মধ্যে চিংড়ি চাষ নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে। আগে যখন প্রাকৃতিক উপায়ে রেণু পোনা সংগ্রহ করে ঘেরে চাষ করা হতো, তখন এখানকার চিংড়িতে রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব খুব একটা দেখা যায়নি। কিন্তু যখন থেকে হ্যাচারি পোনার ওপর সাধারণ চাষিরা নির্ভর করতে লাগলেন, সে সময় থেকেই নানা ধরনের রোগ-বালাই ও ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিতে থাকে।

অন্যদিকে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, এ জেলায় চিংড়িতে এত মারাত্মক আকারে ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ঘেরে পানিস্বল্পতা ও পরিবেশসম্মত উপায়ে চিংড়ি চাষ না করা। জেলার অধিকাংশ ঘেরেই ৩ ফুট পরিমাণ পানি থাকে না। এছাড়া এখানে ঘেরগুলোও তৈরি করা হচ্ছে বেশ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। যে রেণু পোনা ছাড়া হয়, তা ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত নয়। ঘেরের তলাও ঠিকমতো শুকানো হয় না। যথাযথভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে চাষ না করার কারণেই ঘেরে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে মড়ক লেগে চিংড়ি মরে যায়। এর পরও জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকার চিংড়িচাষিদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে, যাতে করে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চিংড়ি চাষ করা যায়।বি-বি

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন