সামুদ্রিক শৈবাল চাষ পদ্ধতি

1633

যে জাতি পুষ্টি নিরাপত্তায় যত সবল, সে জাতি পৃথিবীতে তত বেশি অগ্রগামী। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। শুধু ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে দেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সামুদ্রিক মৎস্যের জল আয়তনের অর্থনৈতিক এলাকা ৪১,০৪১ বর্গ নটিক্যাল মাইল হতে পারে পুষ্টি নিরাপত্তার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সফল শৈবাল চাষে উৎপাদিত সামুদ্রিক শৈবাল এনে দিতে পারে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা।

রফতানিযোগ্য পণ্য সামুদ্রিক শৈবাল:

বর্হিবিশ্বে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে শৈবালের প্রতি বছরে উৎপাদন প্রায় ১০ মিলিয়ন টন যার আর্থিক মূল্য ১২ বিলিয়ন ডলার। এ্যাকুয়াকালচার উৎপাদনে শৈবালের অবস্থান দ্বিতীয়। শৈবাল সম্ভাবনাময় জলজ উদ্ভিদ যার পুষ্টিমান অন্যান্য জলজ প্রজাতির চেয়ে কম নয়।

শৈবাল চাষ, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত:

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রায় ১৪০ ধরনের শৈবাল জন্মে। তাছাড়া প্যারাবন এলাকাতেও ১০ প্রকারের শৈবাল পাওয়া যায়। দেশে শৈবাল চাষ একটি সম্পূর্ণ নতুন উদ্যোগ এবং এর চাষ পদ্ধতি খুব সহজ। সেন্টমার্টিন দ্বীপে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি প্রজাতি Caulera racemosa, Hypnea sp. স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত শৈবাল চাষের সূচনা হয়। গবেষণা কার্যক্রমের অগ্রনায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক ড. মোহাম্মদ জাফর। তাঁর গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশের উপকূলীয় জলরাশিতে শৈবাল চাষ সম্ভব।

শৈবাল চাষে তুলনামূলক সুবিধা:

শৈবাল চাষীদের জন্য স্বল্প বিনিয়োগের নিশ্চয়তা শৈবাল চাষকে সমপ্রসারিত করতে পারে অনেকখানি। গৃহস্থালী উপকরণ (দড়ি, বাঁশ, জার, প্লাস্টিক বয়াঃ) ব্যবহার করে চাষীরা সহজে এ চাষ পদ্ধতি শুরু করতে পারে। জোয়ার ভাটার মাঝের স্থানে অধিকাংশ শৈবাল জন্মায়। সে কারণে ভূমিহীন চাষীগণ খাস সরকারি অনাবাদি জলাভূমিতে বিনা বাধায় চাষ করতে পারবে।

শৈবালের ওষুধি গুণ:

আন-র্জাতিক বাজারে শৈবালের দিন দিন চাহিদা বাড়ছে, কারণ শৈবালে আছে ওষুধিগুণ। শৈবাল টিউমার, রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি কমায়।

শৈবাল চাষ কেন:

অনুসন্ধানে দেখা যায় প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্মানো শৈবাল বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় জনগণ ঐুঢ়হবধ শৈবাল কুড়িয়ে, তা শুকিয়ে বিদেশে রফতানি করে এবং কিছু শৈবাল সার হিসেবে ব্যবহার করে। পর্যাটকদের অবাধে চলাফেরা, নৌ-চালনা, পাথর আহরন এসব কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপে শৈবালের আবাসস্থলে কিছুটা অসুবিধা হয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে শৈবাল সংগ্রহ না করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে শৈবাল চাষাবাদ করলে শৈবালের গুণগতমান যেমন রক্ষা হয় তেমনি আর্থিকভাবে লাভবানও হওয়া যায়।

বিকল্প আয়ের উৎস:

উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম খুব সীমিত। এ অঞ্চলের জনসাধারণ বেশিরভাগ সময় বেকার থাকে। তারা দৈনিক ভিত্তিতে আয় করে। অর্থ জমানোর সুযোগ থাকে না। ফলে আর্থিক অভাব অনটন তাদের লেগেই থাকে, বাড়ে ঋণের বোঝা। পরিণামে চাষীপল্লীতে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করে। উপকূলীয় অঞ্চলের চাষীদের বিকল্প আয়, স্থিতিশীল পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে শৈবাল চাষ উল্ল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

শৈবাল চাষের জন্য বিবেচ্য বিষয়:

১. বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি নির্বাচন
২. সঠিক স্থান নির্বাচন
৩. বাঁশের ফ্রেম তৈরির কৌশল
৪. শৈবাল আহরনের কৌশল
৫. শৈবাল প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশল।

শৈবাল চাষ পদ্ধতি:

বাংলাদেশে অনেকগুলো চাষযোগ্য ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ শৈবাল হচ্ছে Caulera racemosa, Hypnea sp, Sargassum । শৈবাল চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। লোকজনের আনাগোনা কম ও পরিষ্কার সমুদ্রের পানিতে খুঁটি বসাতে হবে। তারপর খুঁটির দুপ্রান্তে দড়ি আটকিয়ে এবং বাঁশের ফ্রেম তৈরি করে তার মধ্যে জাল লাগিয়ে শৈবাল চাষ করা যায়। দড়ির ফাঁকের মাঝে শৈবাল টিস্যু নরম সুতা দিয়ে আটকিয়ে দিতে হবে যেন পানির স্রোতে ভেসে না যায়।

শেষ কথা:

উপকূলীয় অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচন, পারিবারিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আনয়নে শৈবাল চাষ খুলে দিতে পারে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার নতুন দুয়ার। পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের অংশগ্রহণে নতুন মাত্রা যোগ করে জনগণের পুষ্টির অভাব পুরণ ও রোগ প্রতিরোধে আগামী দিনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই শৈবাল চাষ।

লেখক: মো. তৌফিক আরেফীন, কৃষিবিদ, ঢাকা।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৮মে২০