সাম্প্রতিক বন্যা ও বন্যা পরবর্তী উদ্ভুত পরিস্থিতিতে করণীয়

705
18907793_303-696x392

টানা ভারী বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলের পানিতে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যায় সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে মাঠে থাকা আউশ ধান,আমন ধানের বীজতলা, গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির মাঠ এবং ফলদ বনজ গাছপালা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ একে প্রতিহত করা প্রায় অসম্ভব। এ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষিতে কিছু কৌশল অবলম্বন করলে ফসল রক্ষাসহ মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে ফসল রক্ষা করা যায়। সাম্প্রতিক বন্যা ও বন্যার পরবর্তী উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষিতে করণীয় বিষয়ক কৌশলগুলো নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ছবি: সংগৃহিত

আমন ধানের বীজতলা
এখন আষাঢ় মাস, আমন ধানের বীজতলা তৈরির উৎকৃষ্ট সময়। বন্যায় প্লাবিত হতে পারে এমন জায়গায় আমন ধানের বীজতলা তৈরি করা উচিত হবে না। বন্যামুক্ত উঁচু জায়গায় বীজতলা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে ভাসমান বীজতলা তৈরি করতে হবে। এজন্য কলাগাছের ভেলা বা চাটাইয়ের উপর কাদা মাটির প্রলেপ দিয়ে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়। ভাসমান বীজতলাটি অবশ্যই একটি দড়ির সাহায্যে খুঁটি বা গাছের সাথে বেঁধে রাখতে হবে নতুবা বীজতলাটি ভেসে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় নাবি জাতের আমন ধানের প্রতি বিশেষ জোড় দিতে হবে। এজন্য বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল, নাইজার শাইল ও অন্যান্য স্থানীয় জাতের আমন ধান চাষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নিজের কাছে না থাকলে, সম্ভব হলে নিকটবর্তী কৃষক বা বীজ ডিলারের কাছ থেকে এসব জাতের বীজ সংগ্রহ করে নিতে হবে। নাবি জাতের আমন ধানের বীজ ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বীজতলায় বপন করা যায়। বন্যার পানি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে আমন বীজতলা তৈরিতে বাধা সৃষ্টি হলে প্রয়োজনে দাপগ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করা যায়। দাপগ বীজতলায় উৎপাদিত চারা দুই সপ্তাহের মধ্যে বা পানি নামার সাথে সাথে জমিতে চারা রোপণ করতে হবে।

আউশ ধান
মাঠে বিদ্যমান অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়ে আউশ ধানের জমি থেকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে পাতা মোড়ানো পোকা ও গলমাছির আক্রমন হতে পারে। নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করে ব্যাপক আক্রমন হওয়ার পূর্বেই দমনের ব্যবস্থা নিন। তাছাড়া বন্যা পরবর্তীতে ধানে ব্লাস্ট ও বাদামি দাগ রোগ হতে পারে। ব্লাস্ট রোগ দমনে নেটিভো/ট্রুপার জাতীয় ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। বাদামি দাগ রোগের জন্য বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫-৭ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে পারেন। তাছাড়া শতকরা ৮০ ভাগ পাকা আউশ ধান আজই মাঠ থেকে কেটে মেশিনের সাহায্যে মাড়াই ঝাড়াই করে সংগ্রহ করতে হবে।

JMS_AGR029

গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ও আগাম রবি ফসল
আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলী জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে ছাই মিশিয়ে দিতে হবে এবং সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। আগাম শীতকালীন সবজি চাষের জন্য বাড়ির আঙ্গিনায়, টব, মাটির চাড়ি, কাঠের বাক্স, কাটা ড্রাম, পুরোনো টিন, পলিব্যাগ, প্লাস্টিক কন্টেইনার, কলার ভেলায় ফুলকপি, বাধাকপি, টমেটো, বেগুন, লাউ, মরিচের চারা উৎপাদন করতে পারেন এবং সময় বুঝে মূল জমিতে রোপন করতে হবে। বাধের ধারে বা কচুরিপানার স্তুপের উপর পরিমান মতো মাটি দিয়ে লাউ ও শিমের বীজ পুতে দিতে হবে। বন্যার পানি নেমে গেলে বিনা চাষে গিমাকলমি, লালশাক, ডাটা, পালং শাক, পুইশাক, ধনে, আলু, ভুট্রা, সরিষা, মাসকলাই, খেসারী, মটর এসব আবাদ করার প্রস্তুতি নিতে হবে।

অন্যান্য ফসল
বন্যা পরবর্তী মৌসুমে বীজের সংকট মোকাবেলার জন্য সংরক্ষিত বীজ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে ছায়ায় ঠান্ডা করে পুনরায় সংরক্ষণ করতে হবে। রোপিত বনজ, ভেষজ ও ফলের চারার গোড়ায় জমে থাকা পানি নিকাশের জন্য নালা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে গোড়ায় মাটি দিয়ে চারা সোজা করে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। গোড়ার মাটি শুকালে পরিমানমত সার দিতে হবে।

মৎস্য এবং গবাদিপ্রাণী
বর্ষা মৌসুমে বন্যায় মাছ চাষের অনেক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্য পুকুরের পাড় উঁচু করে দেয়া জরুরি। অন্যথায় বন্যায় পুকুরের পাড় ডুবে মাছ চলে যেতে পারে। বন্যার সময় পুকুরে মাছ আটকানোর জন্য জাল, বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আষাঢ় মাস মাছের পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। মিশ্র পদ্ধতিতে মাছ চাষ অত্যন্ত লাভজনক। বড় পুকুর, হাওড়ে, বিলে নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করতে পারেন। তাছাড়া গবাদিপ্রাণির ক্ষেত্রে বন্যার দূষিত পানিতে গরু, মহিষ ও হাঁস কে চরতে না দেওয়াই ভালো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গরু মহিষকে তড়কা, বাদল ও গলাফুলা রোগের টিকা করিয়ে নিন। হাঁসকে ডাক প্লেগ ও কলেরার টিকা দিন। সে জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ভেটেরিনারি মেডিক্যাল ঢীমের সহায়তা নিতে পারেন। বন্যা পরবর্তী কাঁচা ঘাসের ঘাটতি মেটাতে উঁচু পতিত জমিতে উন্নত জাতের ঘাসের চাষ করুন। প্লাবিত চারণ ভূমিতে দ্রুত বেড়ে উঠা কচি ঘাস গবাদিপশুকে খাওয়ালে নাইট্রেট পয়জনিং বা বিষ ক্রিয়ায় গরু-মহিষ হঠাৎ মারা যেতে পারে। এ সব কচি ঘাস রৌদে শুকিয়ে খাওয়ালে বিষক্রিয়ার সম্ভবনা থাকে না। এ সময়ে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কিছু দানাদার খাবার ও ভিটামিন ও খনিজ লবনের মিশ্রণ খাওয়াতে হবে। বর্ষার আগেই গবাদিপশুকে কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়ানোর কথা, তাতে গবাদিপশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি রোগাক্রান্ত হয়ে দ্রুত নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রতিনিয়তই আমাদের কৃষিতে সমস্যা। তাই কৃষি বিষয়ক যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করুন।

লেখক: কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম