প্রাকৃতিকগতভাবেই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর সুপারি উৎপাদন।প্রতিটি সুপারি গাছ অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠে। আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে সুপারী গাছ দেখা যেত এবং তাতে প্রচুর পরিমানে সুপারী হত। সেসময় নদীর পানি গাছের গোড়ায় প্লাবিত হত এবং তাতে মাটি অনেক উর্বর ছিল। মাটিতে জৈব্ সারের পরিমানও ছিল অনেক। দিনে দিনে সুপারী গাছ বিলুপ্তি কাতারে চলে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারন বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের পানির লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়া, মাটির উর্বর শক্তি হ্রাস এবং পরিমাণ মতো জৈব্ সারের অভাব।
সুপারী গাছ রোপণে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়না। তেমন কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে এবটি সুপারী গাছ থেকে বছরে এক-দেড়হাজার টাকার সুপারী পাওয়া সম্ভব। অতি খরা কিংবা অতি বর্ষণ সব ধরণের প্রাকৃতিক প্রতিকুল পরিবেশেই সুপারী গাছ বেড়ে উঠতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুপারী গাছের সঠিক পরিচর্যা নেয়না। যার ফলে গাছ বড় হলেও স্বাভাবিক ফল ধারণ বিঘ্নিত হয়। আবার অনেক সময় পরিচর্যার অভাবে সুপারী গাছ নানা রোগে আক্রামত হয়ে মরে যায়। সুপারী গাছের স্বভাবিক বৃদ্ধি এবং ফল প্রাপ্তির জন্য পরিচর্যা আবশ্যক।
সুপারি গাছের পরিচর্যাঃ- সুপারী গাছের পরিচর্যা করতে হয় বছরে ২ বার। প্রথম বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে এবং ২য় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। সুপারী গাছ থেকে ভাল ফলন পেতে গাছের বয়স এক বছর হলে প্রতি গাছের জন্য ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার ২ ভাগ করে এক ভাগ বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক সার ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ২ বছর হলে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০ গ্রাম এমওপি একই ভাবে দুইভাগ করে একভাগ শুস্ক মৌসুমে অপর অংশ বর্ষায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৩ বছর হলে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার একইভাবে দুই কিসিত্মতে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৪-১০ বছর হলে ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৩০০ গ্রাম এমওপি সার অনুরূপভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সুপারী গাছে মুচি আসার আগে অর্থাৎ মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য বৈশাখ এর মধ্যে গাছের গোড়ার চারিদিকে ২ ফুট দুরত্বে এক ফুট চওড়া ৬ ইঞ্চি গভীর করে মাটি সরিয়ে ফেলতে হবে। পরে ওই মাটির সাথে ৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ৮০০ গ্রাম এমওপি, ৩০০ গ্রাম জিপসাম এবং ১০০ গ্রাম জিংক মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। সার মিশ্রিত ওই মাটি দিয়ে পুনরায় গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। সার প্রয়োগের একদিন আগে প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। যাতে করে ওই মাটিতে তিন দিন পর্যাপ্ত রস থাকে। এছাড়া ফলন্ত গাছের গোড়ায় বছরে একবার ১০ কেজি কম্পোষ্ট অথবা ১০ কেজি কেঁচো সার প্রয়োগ করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সুপারী গাছের পরিচর্যা করা হলে গাছ হবে সতেজ এবং পর্যাপ্ত ফলদায়ক।
সেচঃ- বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি না হলে গাছের গোড়ায় প্রয়োজনীয় পানি/সেচ দিয়ে গাছের গোড়া থেকে এক ফুট দুরত্বে নিড়ানী দিয়ে মাটি কিছুটা আলগা করে সার ছিটিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর গাছের গোড়ায় যাতে প্রয়োজনীয় রস থাকে সে জন্য খড় বা বিচালী বিছিয়ে দিতে হবে।
রোগ বালাই ব্যবস্থাপনাঃ- সুপারী গাছ ও ফল বিভিন্ন প্রকার রোগ পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়। ভালো ফলন পেতে হলে এ রোগবালাই ব্যবস্থাপনা একান্ত অপরিহার্য। প্রধান প্রধান রোগবালাই এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো।
(ক) ফল পচা রোগঃ- রোগের আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত সুপারীর বোঁটায় পানি ভেজা ছোপ ছোপ দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে অনেকগুলো দাগ একত্রে মিশে বড় আকার ধারণ করে। আক্রান্ত স্থান ক্রমান্বয়ে বাদামী ও ছাই রঙের হয়ে এক সময়ে পুরো সুপারীটিই রোগাক্রান্ত হয়ে পচে ঝরে পড়ে।
প্রতিকার ব্যবস্থাঃ- এ রোগ দমনের জন্যে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের শুরুতেই সুপারীর ছড়ায় ও পাতায় ১% বোর্দো মিক্সার অথবা ১.৫% হারে ম্যাকুপ্রাক্স নামক ছত্রানাশক রোগের তীব্রতা অনুযায়ী ১৫-৩০ দিন পর পর ৩/৪ বার গাছে স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত গাছের সুপারী ছড়াসহ পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং গোড়ায় পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
(খ) কুঁড়ি পচা রোগঃ- এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ ক্ষেত্রে ছত্রাক জীবাণু মোচার গোড়ায় কাণ্ডের সংযোগ স্থলের নরম টিস্যু আক্রমণ করে। আক্রান্ত স্থানের টিস্যু প্রথমে হলুদ ও পরবর্তীতে বাদামী রঙ ধারণ করে এবং শেষ পর্যায়ে পচে কালো হয়ে কুঁড়িগুলো ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ- রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই আক্রান্ত স্থান চেছে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পরিষ্কার করে বোর্দো পেস্ট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গাছের পাতা ও মোছায় ১% বোর্দো মিক্সার অথবা ১.৫% কুপ্রাভিট ১৫-২০ দিন অন্তর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। মৃত গাছ, ফলপচা রোগে আক্রান্ত মোচা ও ফল সরিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে এবং বাগানের সমস্ত গাছে ১% বোর্দো মিক্সার অথবা কুপ্রাভিট স্প্রে করে সকল গাছ ভিজিয়ে দিতে হবে।
(গ) মোচা শুকিয়ে যাওয়া ও কুড়ি ঝরাঃ- এ রোগটি প্রধানত গ্রীষ্মকালে হয়ে থাকে। রোগের আক্রমণে আক্রান্ত মোছার গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত হলুদ হয়ে যায়, পরবর্তীতে গাঢ় বাদামী রঙ ধারণ করে এবং পুরো মোচাটি শুকিয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত মোচার কুঁড়িগুলো ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ- আক্রান্ত গাছের মোচা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই ‘ডায়থেন এম-৪৫ অথবা নোইন নামক ছত্রানাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ চা চামচ হিসেবে গাছে মোনা বের হলেই ১৫ দিন পরপর ৪-৫ বার স্প্রে করতে হবে।
(ঘ) মাকড়ঃ- সুপারী গাছ কয়েক ধরনের মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয় যেমনÑ লাল মাকড়, সাদা মাকড়, হলদে মাকড়। সকল বয়সের সুপারী গাছেই লাল ও সাদা মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ পোকা পাতার রস চুষে খায়। ফলে আক্রান্ত পাতা প্রথমে হলুদ ও পরে তামাটে রঙ ধারণ করে এবং পরিশেষে শুকিয়ে যায়। আস্তে আস্তে পুরো পাতাই শুকিয়ে যায়, গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থাঃ- এ মাকড় দমনের জন্য ১০ লিটার পানিতে ৫ চা চামচ ‘ক্যালথেন’ নামক মাকড়নাশক পাতার নিচের দিকে ১৫-২০ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
(ঙ) মোচার লেদা পোকাঃ- এ পোকার মথ কচি মোচায় ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে ক্রীড়া বের হয়ে অফুটন্ত মোচার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং মোচার মধ্যে কচি-ফুলগুলো খেতে থাকে এবং মল ত্যাগ করে সম্পূর্ণ মোছাটাকেই পূর্ণ করে ফেলে। আক্রান্ত মোচায় ফুল আসে না এবং মোচাটিও ফুটে না।
প্রতিকারঃ- আক্রান্ত মোচা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছসহ সকল গাছে ১০ লিটার পানির সঙ্গে ৬ চা চামচ সুমিথিয়ন মিশিয়ে ১৫-২০ দিন পরপর ২-৩ বার মোচায় স্প্রে করতে হবে।
(চ) শিঁকড়ের পোকাঃ- এ পোকার কীড়া বা বাচ্চা গাছের শিকড়ে আক্রমণ করে। এরা প্রথমে গাছের কচি ও নরম শিকড় খেতে শুরু করে। অতঃপর গাছের শক্ত ও পুরানো শিকড় খেয়ে ফেলে। ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায়, উপরের কাণ্ড চিকন হয়ে আসে এবং ফলন কমে যায়।
প্রতিকারঃ- এ পোকার আক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলেই গাছের চারপাশে ১ মিটার ব্যসার্ধে হালকা করে কুপিয়ে বাসুডিন ১০ কেজি অথবা ফুরাটার ৩জি গাছ প্রতি ১০ গ্রাম হারে ছিটিয়ে পানি সেচ দিতে হবে এবং মালচিং করে দিতে হবে। বছরে দু’বার অর্থাৎ বর্ষার আগে ও পরে এভাবে মালচিং করে দিতে হবে। তাহলে এ পোকার আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৮জুন২০