বাজারে ডিম পাড়া লেয়ার মুরগি বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। ডিমের দাম বাড়ায় লেয়ার মুরগি বিক্রি খামারিরা বন্ধ করছেন। তাই ব্রয়লার মুরগি অনেকে পছন্দ করেন না তাই তারা সোনালী মুরগি খেতে পছন্দ করেন। মাংস উৎপাদনকারী দেশী মুরগির আদলে আবিস্কৃত সোনালী মুরগির চাহিদা বাজারে তুঙ্গে। এমন একটা মুরগির চাহিদা ও বিক্রি নিয়ে বেশ অনুসন্ধান করা হয়। বাজারে এই মুরগির চাহিদা কিভাবে মেটানো সম্ভব যদি তা দেশীর সমকক্ষ হয়! এসব প্রশ্নের উত্তর অবশেষে মেলানো সম্ভব হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাজারে আমরা যে সোনালী মুরগি কিনতে পাচ্ছি তা প্রকৃতপক্ষে সোনালী মুরগি নয়। সোনালী মুরগির আপডেট জাত। সোনালী বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ব্রিডিংকৃত একটি জাত হলেও তাতে ক্রমাগত ক্রস করার কারণে ভেজাল হয়ে স্বাদ কমে গেছে। বর্তমানে সোনালী মুরগির নামে আমরা যা খাচ্ছি তা টাইগার, হাইব্রিড সোনালী নামে পরিচিত। যদিও সাধারণ মানুষ দেদারসে সোনালীর দামে টাইগার কিনে খাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোড আইল্যান্ড রেড (আর আই আর) ও মিশরীয় ফাউমি জাতের মুরগির ক্রসে সোনালি মুরগি তৈরি করা হয়। এজন্য সোনালিকে ক্রসব্রিড মুরগি বলা হয়। পরে ২০১৭ সালে সরকার জি আই স্বত্বের জন্য মুরগিকে নির্বাচিত করে। ১৯৮৭ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আব্দুল জলিল সোনালী জাতের মুরগী উদ্ভাবন করেছিলেন। পরবর্তিতে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শাহ জামালের তত্বাবধানে জাতটির উন্নয়ন করানো হয়।
সোনালী মুরগির জন্মস্থান জরপুরহাট। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলায় সোনালি মুরগির বিকাশ ঘটে। এরপর দ্রুতই এর আশে পাশের জেলা সমূহ ও পরবর্তিতে সারা বাংলাদেশেই এটি ছড়িয়ে পড়ে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মাংস ও ডিমের স্বাদের কারণে সোনালি মুরগি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরেরও একটি পছন্দের নির্বাচিত জাত। কিন্তু নতুনভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক জাত উদ্ভাবনের বিপক্ষে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা: এস এম খুরশীদ আলম বলেন, আমি নিজে দেখেছি সোনালী মুরগির নামে বেশ কয়েকটি জাত পালন করা হচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ জাতগুলো বড় হচ্ছে। সোনালী মুরগের সাথে অন্য মুরগির ক্রস করে টাইগার, সোনালী হাইব্রিড ইত্যাদি নাম দেওয়া হয়েছে। এসব মুরগির স্বাদ অনেক কম সোনালীর তুলনায়। দাম কিন্তু সোনালীর মতোই। বাজারে সোনালী নামেই বিক্রি হচ্ছে। নাটারের সিংড়া, নলডাঙ্গায় এসব ক্রসকৃত মুরগি বেশি পালন করা হয়।
ঐ এলাকার কয়েকজন খামারির সাথে কথা বলে জানা গেছে, সোনালী মুরগি ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজন হতে সময় লাগে ৬৫ থেকে ৭০ দিন। এ সময়ের মধ্যে নানান পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করা হয়। কিন্তু সোনালীর টাইগার কিংবা হাইব্রিড সোনালী পালনে ৫০ দিন সময় লাগে। যদি ৭০ পর্যন্ত পালন করা হয় তাহলে মুরগির ওজন দাঁড়ায় দেড় কেজি পর্যন্ত। ওজনে বাড়তি হওয়ার লাভ বেশি হয়। কিন্তু বাজারে বিক্রি হয় সোনালী নামেই। সোনালী মুরগি কম বড় হয় তাই বিক্রির কৌশল হিসেবে অল্প দিনের মধ্যে ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজন হলেই তারা বিক্রি করে দেন। ফলে সাধারণ জনগণ বুঝতে পারেন না যে তারা কি মুরগি খাচ্ছেন।
শনিবার (১ অক্টোবর ২২) রাজশাহীর সাহেববাজার মুরগিপট্টি, উপশহর নিউমার্কেট, লক্ষীপুর কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে লেয়ার মুরগির কোন অস্তিত্ত্ব নেই। বাজারে সেই জায়গা দখল করেছে হাইব্রিড জাতের সোনালী মুরগি।
রাজশাহীর সাহেববাজারের মুরগি ব্যবসায়ী লিখন হোসেন বলেন, বাজারে লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে না। ডিমের দাম বাড়ার কারণে খামারিরা লেয়ার মুরগি বিক্রি করছেন না। বাজারে এখন সোনালী ও ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে। এমনকি কক মুরগিও দেখা মিলছেনা। বাজারে সোনালী মুরগির আদলে আরেক ধরনের মুরগি এসেছে। এগুলো হাইব্রিড জাতের সোনালী। যেখানে আসল সোনালী মুরগি ৭০ দিনে ৬’শ কিংবা ৭’শ গ্রাম ওজন হয় সেখানে এই হাইব্রিড জাতের সোনালী ৪০ দিনে এককেজি হয়ে যায়। জনগণ বুঝতে পারছে না কোনটা আসল সোনালী মুরগি আর কোনটা হাইব্রিড। সোনালী মুরগির দামেই কিন্তু বিক্রি হচ্ছে। সোনালী মুরগির নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহক আমাদের আছে যারা এই মুরগি চিনতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্রেতারা বুঝতে পারেনা।
একই বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী রাকিবুল ইসলাম বলেন, বাজারে এখন সোনালী মুরগি আর ব্রয়লার মুরগির চাহিদা বেশি। অন্যান্য মুরগি বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। সোনালী ২৭০ থেকে ২৭৫ টাকা এবং ব্রয়লার বিক্রি করছি ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। মুরগির দাম আরো কমবে।
রাজশাহী অঞ্চলে সর্বপ্রথম সোনালী মুরগি পালন শুরু করেছিলেন এনামুল হক। তিনি জয়পুরহাট থেকে বাচ্চা নিয়ে এসে রাজশাহীতে পালন করে বিক্রি করতেন। তাঁর ভাস্যমতে সোনালী মুরগির ব্রিডিং হচ্ছে। জাতের উন্নয়ন করা হয়েছে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে এই হাইব্রিড সোনালী যার মাতাপিতা কিন্তু আদী সোনালী।
রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, বাজারে সোনালীর নামে আরেক প্রকার মুরগি বিক্রি হচ্ছে যা আমরা সোনালী নামেই খেয়ে চলেছি। আসল সোনালী মুরগির যে স্বাদ তা এই সোনালীতে নেই। দাম কিন্তু সোনালীরই। খামারিরা যেদিকে লাভবান হবেন সেদিকেই যাবেন।
এ বিষয়ে কথা হয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার পরিচালক জিনাত আরার সাথে। তিনি বলেন, আমি এখন পর্যন্ত সোনালী মুরগির নতুন জাত বিষয়ে জানি না। আপনার কাছে তথ্য পেলাম। নাটোর এলাকার ডিএলও’র সাথে কথা বলে জানব বিষয়টি। পরে এ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
যদি নতুন জাত এস যায় তাহলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর স্বাগত জানাবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা সোনালীতেই থাকতে চাই। নতুন জাত খুব সহজে টিকতে পারবে না। তাতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৪অক্টোবর ২০২২