আলু বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। সেই সাথে অর্থকরী ফসলও। প্রতি বছর এ দেশে আলুর উৎপাদন যে পরিমাণে হিমাগারে রাখা যায় তার চেয়েও বেশি। তারপরও খাদ্য হিসেবে আলুর ব্যবহার দিন দিন এমনভাবে বেড়ে গেছে যে, বাজারে আলুর দাম কখনোই আর কম থাকছে না। সে জন্য প্রতি বছরই আলুর মৌসুম শুরুর আগে শুধু কৃষকরাই নয়, যারা কৃষি কাজের সাথে জড়িত নন এমন অনেকেই আলু চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
কারণ আলু চাষে স্বল্প সময়ে লাভ বেশি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ না রাখায় আলু চাষে অনেকেই কাংক্ষিত ফল বা ফলন পান না। তখন বিভিন্ন জনকে বিভিন্নভাবে দোষারোপ করেন। তাই আলু চাষে নামার আগে থেকেই যদি কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় তাহলে আলুর কাংক্ষিত ফলন পাওয়া সম্ভব হতে পারে। প্রথমেই জমি নির্বাচন।
বেলে বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে আলু ভালো হয়। সূর্যের আলো প্রচুর পড়ে এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি আলু চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত। জমিতে পানি সেচ দেয়া ও পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্খা থাকাও প্রয়োজন। এ জন্য জমি সমতল করতে হয়। যেহেতু আলু মাটির নিচের ফসল, তাই জমি গভীর চাষ দিতে হয়। জমি চাষ দেয়ার পর ৭ থেকে ১৫ দিন রোদে ফেলে শুকিয়ে নিতে হয়। এতে মাটির নিচে থাকা বিভিন্ন পোকা, পোকার কিড়া ও পুত্তলী এবং রোগজীবাণু রোদের আলো ও তাপের সংস্পর্শে এসে নষ্ট হয়।
আড়াআড়ি চাষ দিয়ে মাটি এমনভাবে চিকন ও ঝুরঝুরে করতে হয় যেন মাটির মধ্যে বাতাস চলাচল ভালোভাবে করতে পারে, যাতে আলুর টিউবার গঠন কাজটি সহজ হয়। চাষের শেষে জমির সব আগাছা ও আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে দূরে কোথাও পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হয়। তবে জমি তৈরির আগে মাটি শোধন করে নিতে পারলে ভালো হয়। এতে আলুর ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধ করা যায়। আগের বছর ঢলে পড়া রোগ হয়নি বা রোগ হয়েছে এমন যেকোনো জমিতেই মাটি শোধন করে নিতে হয়। শেষ চাষের আগে বিঘা প্রতি ৪ থেকে ৫ কেজি ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে চাষ দিয়ে সেচ দিতে হয়।
ব্লিচিং পাউডার জমির মাটির সাথে মেশানোর পর জমিতে অবশ্যই জো অবস্থা থাকতে হয়। এভাবে ২৮ থেকে ৩০ দিন জমি ফেলে রাখতে হয়। এতে জমির মাটি শোধন হয় অর্থাৎ মাটির বিশেষ বিশেষ রোগ জীবাণু ধ্বংস হয় বা তাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। জানা উৎস বা বিশ্বস্ত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আলুবীজ সংগ্রহ করতে হয়। বীজ আলু যদি খারাপ হয় তাহলে আলু চাষের সব আয়োজনই বিফলে যেতে বাধ্য। তাই যেনতেন জায়গা বা যে কারো কাছ থেকে বীজআলু সংগ্রহ না করে এমন উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয় যেন আলুর বীজ খারাপ হলে তার জন্য জবাবদিহিতা থাকে। বীজ সংগ্রহের পর বীজ শোধন করতে হয়।
এ জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা না করলেও চলে। যেমন কেউ কেউ কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এ জাতীয় ছত্রাকনাশক বীজ আলু শোধনে ব্যবহার করলে ১ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১ কেজি কাটা বীজ আলু ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে বীজবাহিত ছত্রাকঘটিত রোগজীবাণু ধ্বংস হয়। আলুর ঢলে পড়া ও গোড়া পচা রোগ প্রতিরোধে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে স্ট্রেপটোমাইসিন মিশ্রিত করতে হয়। বীজ আলু সংগ্রহের পর কাটার আগে আলো-বাতাস চলাচল করে এমন পরিষ্কার সমতল জায়গায় বস্তা খুলে আলু বের করে এক থেকে দেড় ফুট উঁচু স্তূপ বা হিপ করে ছড়িয়ে রাখতে হয়। মাঝে মধ্যে ওলটপালট করতে হয়। বীজআলু শুধু লম্বালম্বি এমনভাবে দু’ভাগ করে সমভাবে কাটতে হয়, যাতে কর্তিত দু’অংশে কমপক্ষে দুটি করে চোখ থাকে।
এই অংশের ওজন ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম এবং ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট হতে হয়। অনেকেই চোখের সাথে আলুর অংশ কম রেখে বাকিটুকু খাবার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, এটা ঠিক নয়। কর্তিত অংশের সাথে যতটুকুই থাকুক সবটুকুই রাখতে হয়। বীজ কাটার সময় চাকু বা বঁটির দুই পাশ জীবাণুনাশকে ভেজানো কাপড়ের টুকরো দিয়ে মাঝে মধ্যে মুছে নিতে হয় যেন রোগজীবাণু এক আলু থেকে অন্য আলুতে ছড়াতে না পারে। আলুর কাটা অংশ উপরের দিকে করে মাটিতে ছড়িয়ে বিছিয়ে রাখতে হয়। কখনোই গাদাগাদি করে রাখা উচিত নয়। রাখার স্থানে আলো এবং বাতাস চলাচল ব্যবস্থা থাকতে হয়। এভাবে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা রেখে দিলে কাটা অংশের ওপরে একটি শক্ত কালচে ধরনের স্তর পড়ে, যাকে সোবারাইজেশন বলে। এই অংশ ভেদ করে কোনো রোগজীবাণু ঢুকতে পারে না।
কাটা অংশে ছাই ব্যবহার করা যেতে পারে, তাতে অতিরিক্ত হিসেবে পটাশিয়াম সরবরাহ করা হয়। আবার পোকার বিকর্ষক হিসেবেও এটি কাজ করে। আলু রোপণের উপযুক্ত সময় হলো নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ পর্যন্ত। দিন পেছালে শীতে গাছের বৃদ্ধি কমে, গাছ খুব বেশি বড় হওয়ার আগেই টিউবার গঠন কাজ শুরু হয়ে যায়। এতে টিউবার সংখ্যা কমে যায়। শীতে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের টিউবার গঠন ভালো হয়। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আলুবীজ রোপণ করা যায়, তবে ফলনও আনুপাতিক হারে কমে যায়। আলু চাষে কম্পোস্ট সার ব্যবহার না করা ভালো। কারণ যেসব কম্পোস্টের উপাদান হিসেবে শাকসবজির উচ্ছিষ্টাংশ বা গাছ-গাছড়ার বা যেকোনো জৈব জিনিসের পচনশীল অংশ ব্যবহার করা হয় সেসবের সাথে ঢলে পড়া রোগের রোগজীবাণু থাকতে পারে, যা এই রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য কম্পোস্টের পরিবর্তে ভালোভাবে পচানো শুকনো গোবর সারই জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা ভালো।
সবচেয়ে ভালো হয় বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে সংগ্রহ করা শুকনো সার। আলু চাষে একর প্রতি ইউরিয়া ১১২ কেজি, টিএসপি ৭৫ কেজি, এমওপি ১১২ কেজি, জিপসাম ৪০ কেজি, জিংক সালফেট ৫ কেজি এবং বোরণ সার ৪ কেজি ব্যবহার করতে হয়। অর্ধেক ইউরিয়া, অর্ধেক এমওপি ও সম্পূর্ণ টিএসপি এক সাথে মিশিয়ে বীজ আলু বপনের পাশে সারের নালায় দিতে হয়। বাকি সার রোপণের ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। আর জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বোরণ সার শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। যেসব অঞ্চলের মাটিতে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি আছে সেসব অঞ্চলে ম্যাগনেশিয়াম সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়।
উপরি সার প্রয়োগের পর আলুর সারিতে বা গাছের গোড়ায় উঁচু করে (প্রায় ২০ সেন্টিমিটার) মাটি তুলে দিতে হয়। ভেলির গোড়া চওড়া রাখার জন্য ১৫ সেন্টিমিটার প্রস্থের ছোট কোদাল ব্যবহার করতে হয়। মাটি তোলার সময় লক্ষ্য রাখতে হয় যেন কোদালের সাথে প্রয়োগকৃত সার উঠে না আসে। আলু চাষে সেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোপণের সময় জমির জো অবস্থা থাকতে হয় এবং রোপণের পর ১ থেকে ২টি গাছ যখন মাটির ওপরে উঠে আসে তখন প্রথমবার সার উপরি প্রয়োগের পর একটি হালকা সেচ দিতে হয়।
এটি সাধারণত রোপণের ৭ দিনের মধ্যে দিতে হয়। এবপর মাটির প্রকার ও প্রয়োজন অনুযায়ী ৩ থেকে ৫ বার সেচ দিতে হয়। তবে টিউবার গঠনের শুরুর সময় অর্থাৎ ৪০ থেকে ৪৫ দিনের সময় মাটিতে রস না থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বা ফলন কমে যেতে পারে। সুষম সেচের জন্য তাই নিয়মিত জমি পরিদর্শন করতে হয়। খাবার আলু ৯৮ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। আর বীজ আলু ৭২ থেকে ৭৫ দিন পর গাছ তুলে রেখে ৮০ থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে ক্ষেত থেকে তুলতে হয়। জাত ভেদে বাংলাদেশে আলুর ফলন একর প্রতি ৭ থেকে ১০ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১০মে২০