বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পশু সম্পদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আদিকাল থেকেই গবাদিপশু এদেশের প্রত্যকটি কৃষকের বাড়ীতে হাল চাষ, গাড়ী টানা, দুধ ও মাংস উৎপাদনের জন্য পালন হয়ে আসছে। বর্তমানে কৃষি যন্ত্রায়ন এবং বিভিন্ন ধরনের যানবাহন সহজলভ্য হওয়ার কারনে গবাদিপশু দ্বারা হাল চাষ ও মালামাল পরিবহণের কাজে ব্যবহার অনেকটা কমেছে। বর্তমানে শুধু দুধ ও মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে গবাদিপশু পালন করা হয়ে থাকে।
কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ গবাদিপশু অনুন্নত জাতের হওয়ায় এদের দুধ ও মাংস উৎপাদন ক্ষমতা অত্যন্ত কম। দেশী জাতের একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ষাঁড়ের ওজন ২০০-২২৫ কেজি, গাভীর ওজন ১৫০-২০০ কেজি ও দুধ উৎপাদন ১-৩ লিটার মাত্র। অপরদিকে উন্নত জাতের একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ষাঁড়ের ওজন ৩৫০-৪৫০ কেজি, গাভীর ওজন ৩০০-৪০০ কেজি ও দুধ উৎপাদন ১০-১৫ লিটার। পশু সম্পদ উন্নয়নে আমরা এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছি।
বর্তমানে গবাদি পশু থেকে যে পরিমাণ দুধ ও মাংস উৎপাদন হয় তা জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় কম। তাই মাংসের জন্য জীবন্ত গরু এবং দুধ জাতীয় খাদ্যের চাহিদা পূরণে বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে গুড়াদুধ আমদানী করতে হয়। এ সকল পণ্য আমদানীর কারণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় যা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল নয়। তাই অধিক হারে দুধ এবং মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে অনুন্নত জাতের গবাদি পশুর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। একটু সচেতন হলেই এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করা সম্ভব। গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন দুভাবে করা যায়, যেমন- ক) জেনেটিক উন্নয়ন ও খ) পরিবেশগত উন্নয়নের মাধ্যমে।
জেনেটিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রজনন পদ্ধতি। আমাদের দেশের অনুন্নত জাতের বকনা বা গাভীগুলোকে জার্সি, হলেস্টেইন, ফ্রিজিয়ান, সিন্ধি ও শাহীওয়াল জাতের ষাঁড় দ্বারা প্রজনন ঘটিয়ে উন্নত জাতে রূপান্তর করা সম্ভব। প্রজনন দু পদ্ধতিতে হয়, যেমন- প্রাকৃতিক প্রজনন পদ্ধতি ও কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি।
প্র্রাকৃতিক প্রজনন পদ্ধতি: উন্নত জাতের ষাঁড় দ্বারা দেশী জাতের গাভীর মিলন ঘটিয়ে উন্নত জাতের বাছুর জন্মানোর প্রক্রিয়া হল প্রাকৃতিক প্রজনন পদ্ধতি। উন্নত জাতের ষাঁড় হল প্রাকৃতিক প্রজনন পদ্ধতির পূর্ব শর্ত।
কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম উপায়ে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য সংগ্রহ করে বিজ্ঞান সম্মতভাবে সংরক্ষণ করা হয়। গাভীর প্রজনন উদ্যমের লক্ষণ দেখা দিলে যান্ত্রিক উপায়ে স্ত্রী জনন তন্ত্রের নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট পরিমাণ বীর্য প্রবেশ করানো হয়। পরবর্তীতে গাভী গর্ভবর্তী হয়ে উন্নত জাতের বাছুরের জন্ম দেয়। এই পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া বাছুরের মধ্যে ৫০% উন্নত জাতের ষাঁড়ের গুনাগুণ থাকতে পারে। ফলে এসব বাছুর থেকে পূর্ণাঙ্গ বয়সে অধিক হারে দূধ ও মাংস উৎপাদন করা সম্ভব। প্রাকৃতিকভাবে প্রজননের ক্ষেত্রে একটি ষাঁড় বছরে প্রায় ৫০ টি গাভীর সাথে মিলন ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির ক্ষেত্রে বছরে একটি ষাঁড়ের বীর্য দিয়ে প্রায় ১০,০০০ হাজার গাভীকে প্রজনন দেয়া সম্ভব। প্রাকৃতিক প্রজননের জন্য বিদেশ থেকে ষাঁড় আমদানি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই ষাঁড়ের পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন আমদানী করা বেশী লাভজনক। কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে অল্প সময়ে কম খরচে ও ব্যাপক হারে গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন করা সম্ভব। কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে আগামী ১২-১৫ বছরের মধ্যে সারা দেশের অনুন্নত জাতের গাভীগুলোকে পর্যায়ক্রমে উন্নত জাতে রুপান্তর করে ৩ গুন দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
পরিবেশগত উন্নয়ন: সুষম খাদ্য এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটানো যায়। গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশগত উন্নয়নেরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সুষম খাদ্য ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে গবাদি পশু শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে নানা ধরণের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, আকৃতিতে ছোট হয় ও উৎপাদন ক্ষমতা লোপ পায়। গবাদি পশুর শারীরিক বৃদ্ধি, যৌন পরিপক্কতা ও বলিষ্ট হওয়ার জন্য সুষম খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুষম খাদ্য হল- আঁশ জাতীয় খাদ্য (সবুজ ঘাস, সবুজ শস্য, বৃক্ষের পাতা, খড় ইত্যাদি), দানাদার জাতীয় খাদ্য (চাল ভাংগা, গম ভাংগা, ভূট্টা ভাংগা, খেসারি ভাংগা, মসুরী ভাংগা, চালের কুড়া, ব্রান, গমের ভূষি, ডালের ভূষি ইত্যাদি), সরিষা, তিল, সয়াবিন খৈল এবং লবন, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন মিশ্রণ ও বিশুদ্ধ পানি। এ সব খাদ্য আনুপাতিক হারে মিশ্রন করে গবাদিপশুর বয়স, ওজন, গর্ভবতী ও দুদ্ধবর্তী অবস্থার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাওয়াতে হবে। দানাদার, খনিজ-ভিটামিন জাতীয় খাদ্য বাজার থেকে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল ঘাস ও গো-খাদ্য শস্য জমিতে চাষ করতে হয়। আমাদের দেশে জমি স্বল্পতার কারণে এ সব ঘাস জাতীয় খাদ্য ব্যাপক হারে চাষ করা সম্ভব হয় না। তাই উচ্চ ফলনশীল জাতের ঘাস, যেমন- নেপিয়ার, পারা, গিনি, জার্মান, বকশা, জাম্বু ইত্যাদি রাস্তা, রেল লাইনের দু-ধার, বাঁধ, খাল-বিলের পাড় ও চরে চাষ করা যেতে পারে। এ সব ঘাস এক বার রোপণ করে কয়েক বছর পর্যন্ত গবাদিপশুকে খাওয়ানো যায়। সবুজ ঘাস খুবই পুষ্টিকর যা গবাদিপশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও দুধ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবাদিপশু পালনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দরকার। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গবাদিপশুকে সুস্থ, সবল ও অধিক উৎপাদনশীল করে গড়ে তোলা সম্ভব। আবাসন ব্যবস্থা- গরুর বাসস্থান স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য মেঝে পাকা/সেমি পাকা এবং ঘরের মধ্যে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। গরুর ঘর যেন পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। গোয়াল ঘর সবসময় পরিস্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে ও মাঝে মাঝে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে কিছু দিন পর পর গোয়াল ঘরে ধোঁয়া দিতে হবে। গোবর গোচোনা পরিস্কার করে নির্দিষ্ট গর্তে জমা করতে হবে যেন পরিবেশ দূষণ না হয়। রোগ-ব্যাধি ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা- গবাদিপশুর সঠিক সময়ে রোগ প্রতিরোধ ও দমন করতে হবে।
গবাদিপশু সাধারণত: সংক্রমণ রোগ, পরজীবী ঘটিত রোগ ও অপুষ্টি জনিত রোগে বেশী আক্রান্ত হয়। ক) সংক্রমণ রোগ, যেমন- (!) ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ রোগ (দুরারোগ, গো-বসন্ত-, জলাতঙ্ক ইত্যাদি) এবং (!!) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণ রোগ (বাদলা, তড়কা, গলাফুলা, নিউমোনিয়, টিটেনাস, ওলান প্রদাহ ইত্যাদি)।
গবাদিপশুকে বিভিন্ন বয়সে সঠিক সময়ে ভ্যকসিন দিলে এসব রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া যাবে। খ) পরজীবী ঘটিত রোগ, যেমন- (!) অন্তঃপরজীবী-যা পেটের ভিতরে থাকে (গোল কৃমি, ফিতা কৃমি, পাতা কৃমি ইত্যাদি)। নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ সেবন করালে গবাদিপশু কৃমি মুক্ত ও সুস্থ থাকবে। (!!) বহিঃপরজীবী -যা শরীরের বাহিরে চামড়ার উপরে থাকে (উকুন, মশা, ডাস, মাছি, আঠালী, জোঁক ইত্যাদি)। এসব ছাড়াও চামড়ায় চূলকানি, দাদ, কূঁজে ঘা ও জোয়াল কান্দা ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। গবাদিপশুকে নিয়মিত সাবান দিয়ে গোসল, ব্রাশ দ্বারা শরীর পরিস্কার এবং সময়মত ঔষধ সেবন করালে পশু রোগ মুক্ত ও সুস্থ থাকবে। গ) অপুষ্টি জনিত রোগ সুষম খাদ্যের অভাবে হয়, যেমন- হাড়রোগ, দুধজ্বর ও বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি। সুষম খাদ্যের সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভিটামিন মিশ্রণ ও মিনারেল প্রিমিক্স খাওয়ালে পশু সুস্থ ও সবল থাকবে। নিয়মিত গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুুযায়ী ঔষধ সেবন করতে হবে।
গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের কৃষকদের প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা ও ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৪-৫ টি কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। যুবকদের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও যোগাযোগের জন্য যানবাহনের সুবিধা দিয়ে গ্রামের কৃষকের বাড়ী বাড়ী গিয়ে অনুন্নত জাতের গাভীগুলোকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতে রূপান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি, অনুন্নত জাতের গরুগুলোকে উন্নত জাতে রুপান্তর করে সমগ্র দেশে ক্ষুদ্র মাঝারী ও বৃহৎ আকারের খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে গ্রামের বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচন করতে হবে।
অপরদিকে অধিক হারে দুধ ও মাংস উৎপাদন করে আমিষজাতীয় পুষ্টির চাহিদা মিটাতে হবে। এর ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশ থেকে গুড়া দুধ ও মাংসের জন্য জীবন্ত গরু আমদানী করতে হবে না। এছাড়াও গরুর গোবর থেকে বায়ো-গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে জ্বালানি সাশ্রয় হবে এবং কৃষি জমিতে অধিক হারে গোবর সার ব্যবহারের ফলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। চামড়ার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চামড়া শিল্পের প্রসার ঘটবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে এবং বর্হি-বিশ্বের সংগে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৬এপ্রিল২০