সয়াবিন অয়েল কেক আমদানিতে নতুনভাবে শুল্ক আরোপের অপচেষ্টা এবং বাংলাদেশের সীড ক্র্যাশিং ইন্ডাষ্ট্রি

846

(প্রথম পর্ব)

সারাদেশ যখন ‘কোভিড-১৯’ ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণে পর্যুদস্ত; দেশের আপামর মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চিন্তায় উদ্বিগ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন; জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) যখন নভেল কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ডিম, দুধ, মাংস ইত্যাদি পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের উপর জোর দিচ্ছে এবং দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প যখন সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাণিজ আমিষের যোগান নিশ্চিত করতে এবং সেই সাথে রপ্তানী সক্ষমতা তৈরির জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুবিধাসহ উৎপাদন, আমদানি ও বিপনন পর্যায়ে সব ধরনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর থেকে অব্যাহতির আবেদন জানাচ্ছে; ঠিক তখন ‘দি বাংলাদেশ অয়েল মিলস এসোসিয়েশন’ সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেক, রেপসীড কেক ও সানফ্লাওয়ার সীড থেকে উৎপাদিত অয়েল কেক (ঐঝ ঈড়ফব: ২৩০৪.০০.০০ এবং ১২০৮.১০.০০) আমদানিতে ১৫% কাস্টমস ডিউটি এবং ১৫% রেগুলেটরি ডিউটি আরোপের জন্য।

গত ১৯/০৫/২০২০ (ইং) তারিখে এসোসিয়েশনটির পক্ষ থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বরাবরে একটি পত্র প্রেরণ করা হয় যেখানে প্রস্তাবিত হারে শুল্ক ও কর হার আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বৃদ্ধির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সুপারিশ করার আবেদন জানানো হয়। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তরের মতামত জানতে চেয়ে চিঠি দেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গত ৪ জুন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব), বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি), ডেইরি এসোসিয়েশন (বিডিএফএ), এ্যাকুয়া অ্যাসোসিয়েশন (বিএপিসিএ) এবং বাংলাদেশ অয়েল মিলস এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ছাড়াও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ১৫% রেগুলেটরি ডিউটি (জউ) এবং ১৫% কাস্টমস ডিউটি (ঈউ) আরোপ করার দাবির যৌক্তিকতা হিসেবে তাঁদের অর্থাৎ ‘সীড ক্র্যাশিং ইন্ডাষ্ট্রি’র সুরক্ষা’র বিষয়টিকে সামনে আনা হয়েছে। দি বাংলাদেশ অয়েল মিলস এসোসিয়েশন -এর অযৌক্তিক দাবির বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য শিল্প সংশ্লিষ্টদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার গ্রুপেও এ নিয়ে আলোচনা দানা বাঁধে।

খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে- দি বাংলাদেশ অয়েল মিলস এসোসিয়েশনের এ দাবি আসলেই যৌক্তিক নাকি অনধিকার চর্চ্চা? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে সে চেষ্টাই করবো।

ক) অনধিকার চর্চ্চা
সয়াবিন সীড ক্র্যাশিং মিলগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে তেল উৎপাদন করা। এই তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত ‘সয়াবিন সীডে’র উৎপাদন, আমদানি কিংবা সয়াবিন তেলের উৎপাদন, বিপনন ইত্যাদি বিষয়গুলো তাঁদের এখতিয়ারের অন্তর্ভূক্ত কিন্তু তেল উৎপাদনকারি খাত হয়ে যদি মৎস্য, পোল্ট্রি, ডেইরি, গবাদিপশু খাতের উপর খবরদারি করা হয় তবে তা এখতিয়ার বহির্ভূত অনধিকার চর্চ্চা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ভোজ্য তেল উৎপাদনের সুবিধার্থে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে শূণ্য শুল্কে সয়াবিন সীড (ঝড়ুনবধহ যিড়ষব ংববফ) আমদানির সুবিধা গ্রহণ করছেন অথচ ঐ সয়াবিন সীড ক্র্যাশিং করে তেল বের করার পর উপজাত হিসেবে পাওয়া সয়াবিন অয়েল কেক বা সয়াকেক আমদানির ক্ষেত্রে তাঁরাই আবার উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের দাবি জানাচ্ছেন।

খ) ক’বছর আগে ঈউ এর পরিবর্তে জউ আরোপ করা হয়েছিল; এবার একই সাথে ঈউ ও জউ উভয় শুল্ক আরোপের দাবি
পূর্বে সয়াবিন অয়েল কেক/সয়াকেক আমদানিতে কোনো রকমের কর বা শুল্ক ছিল না। পরবর্তীতে সীড ক্র্যাশিং কোম্পানীগুলোর ‘সুরক্ষার’ তত্ত্বেই হয়ত ১৫% কাস্টমস ডিউটি আরোপ করা হয়। মন্ত্রণালয় ও প্রস্তুতকারকদের দাবির প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে সে শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। তবে কাস্টমস ডিউটি আরোপ থাকলেও তখন ঝঅঋঞঅ চুক্তির আওতায় শুল্ক মুক্ত সুবিধায় ভারত থেকে সয়াবিন মিল/সয়াকেক আমদানি করা যেত। কিন্তু সে সুবিধা বন্ধ হয়ে যায় কারণ ৫% ঈউ -এর পরিবর্তে আরোপ করা হয় ৫% জউ.

কোভিড-১৯ সংকটে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাতের প্রতি সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে সহায়তার আশ্বাস জানানো হতে থাকে। তাছাড়া ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা যেন সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম, দুধ, মাছ, মাংস কিনতে পারেন সে লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও আসন্ন জাতীয় বাজেটে সয়াবিন মিল/ সয়াকেকসহ আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর থেকে বিদ্যমান কর ও শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ জানায়। সাম্প্রতিক সময়ে পোল্ট্রি শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত অফাধহপব ঞধী (অঞ) বা আগাম করও প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। এতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে সীড ক্র্যাশিং ইন্ডাষ্ট্রি। ফলে কালবিলম্ব না করে উচ্চহারে ঈউ ও জউ আরোপের আবেদন জানায় তারা।

গ) নিম্নমানের পণ্য জোর করে চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস

একথা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে- বাজারে কোন একটি পণ্যের চাহিদা যখন বিদ্যমান, তখন পণ্যটি যদি গুনগত মানসম্পন্ন হয় এবং উপযুক্ত মূল্যে দেশীয় বাজারে পাওয়া যায় তবে বিদেশ থেকে তা আমদানি করতে যাওয়ার মত বোকামী কেউই করতে যাবেন না; কারণ আমদানি মানেই টাকাকে ডলারে কন্ভার্ট করা, খঈ করা, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য কেনার জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ করা, জাহাজ ভাড়া করে যাত্রাপথের বহুবিধ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সে পণ্য বাংলাদেশের বন্দরে আনা, ল্যাব টেস্ট করা, বন্দর থেকে নিজ গুদামে নিয়ে আসা- প্রভৃতি দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও ধকল সইতে হয়। অথচ ঐ একই পণ্য যদি দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করা হয় তবে এগুলোর কিছুই প্রয়োজন হয়না। কিন্তু এত কিছুর পরও শত ঝুঁকি মাথা নিয়ে যখন সয়াবিন অয়েল কেক বা সয়াকেক আমদানি করছেন দেশীয় ফিড প্রস্তুতকারকগণ তখন এ কথা বুঝতে বাকি থাকে না যে- দেশীয় সয়াকেকের গুণে ও মানে অনেক সমস্যা রয়েছে। আপনার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে- সাধারণত ২ ধরনের সয়াকেক বাজারে পাওয়া যায়: (১) ৪৪% প্রোটিন কনটেন্ট সমৃদ্ধ (লো-প্রোটিন) এবং (২) ৪৬% প্রোটিন কনটেন্ট সমৃদ্ধ (হাই-প্রোটিন)। দেশে উৎপাদিত সয়াকেক মূলত:ই লো-প্রোটিন সমৃদ্ধ। এ ধরনের কাঁচামালে উৎপাদিত পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি ফিডের গুণমান তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে বলে মান নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো আলাদাভাবে সংযোজন করতে হয়, ফলে খরচ বাড়ে। অনেক উৎপাদনকারি এই লো-প্রোটিন সয়াকেক ব্যবহার করতে বাধ্য হন কারণ বিদেশ থেকে এ পণ্য আমদানিতে ৫% হারে জউ বহাল আছে। তাছাড়া ছোট ও মাঝারি আকারের ফিড মিলগুলোর জন্য দেশের বাইরে থেকে এ ধরনের কাঁচামাল আমদানি করা বেশ কঠিন একটি কাজ। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, উন্নত মানের ফিড (যেমন- মুরগির ক্ষেত্রে গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক, প্যারেন্ট স্টক ফিড, ইত্যাদি) তৈরিতে মূলত: হাই-প্রোটিন সয়াকেকই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ফিড প্রস্তুতকারকগণের অভিমত হচ্ছে- দেশে প্রাপ্ত সয়াকেকের চেয়ে অধিক মূল্যেও যদি বিদেশ থেকে সয়াকেক আমদানি করা হয় তবুও ফিডের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয় কারণ দেশীয়ভাবে উৎপাদিত সয়াকেক:
– প্রোটিন নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম থাকে। (ঞবংঃ জবঢ়ড়ৎঃ সংযুক্ত)
– কখনও ঙাবৎ পড়ড়শবফ আবার কখনও বা টহফবৎ পড়ড়শবফ থাকে।
– অসরহড় অপরফ -এর পরিমান নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও কম থাকে।
– গড়রংঃঁৎব বেশি থাকে এবং অনেক অহঃর-হঁঃৎরঃরড়হধষ ঋধপঃড়ৎ এর উপস্থিতি থাকে যা হঁঃৎধষরুব করতে অতিরিক্ত উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। নিম্নমানের সয়াবিন সীড আমদানি করা হয় বলেই পণ্যের মান খারাপ হয়ে থাকে বলে সাধারনভাবে ধারণা করা হয়।
– অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে এতে সিলিকার উপস্থিতি থাকে।
– উঁংঃ বেশি থাকে।

উপরিল্লিখিত সমস্যাগুলোর কারণে একদিকে যেমন মানসম্মত ফিড তৈরি করা সম্ভব হয়না, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়; অপরদিকে উৎপাদন খরচও বেশি হয়।

ফিড প্রস্তুতকারকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ:
– যথাসময়ে মাল ডেলিভারি পাওয়া যায়না।
– দাম খেয়াল-খুশি মত বাড়ানো-কমানো হয়।
– অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না।
– মার্কেটিং কাঠামোটিও পুরোপুরিভাবে ডি.ও নির্ভর এবং অগ্রিম বিক্রয়ের কারণে মধ্যসত্ত্বভোগী ডিলারদের মাধ্যমেই সাধারনত মাল কিনতে হয়। ফলে এক ধরনের অসহায়ত্ব নিয়েই সীড ক্র্যাশারদের দ্বারস্থ হতে হয় তাঁদের।

(দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল)

মো. সাজ্জাদ হোসেন, যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্ট, বিপিআইসিসি

ফার্মসএন্ডফার্মার/১১জুন২০