হঠাৎ মুরগির ডিমের উৎপাদন যেভাবে কমে ও যা করা উচিত

3

ডিমপাড়া মুরগির নানা কারণে ডিমের উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। মুরগি সাধারণত ২০ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করে। অনেক সময় মুরগির স্বাস্থ ও দৈহিক বৃদ্ধি ভালো থাকলে কোন কোন ক্ষেত্রে কয়েক দিন আগেই ডিম দেওয়া শুরু করতে পারে। তবে ২০ সপ্তাহ ডিম পাড়া শুরু হওয়ার সময়কে আদর্শ সময় হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। মুরগির বাচ্চার বয়স ০১ দিন থেকে শুরু করে ২০ সপ্তাহ বয়স পযর্ন্ত যদি ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে মুরগির দৈহিক বৃদ্ধি কাংখিতমাত্রায় পৌছায় সেক্ষেত্রে মুরগি কাংকিত উৎপাদনে আসবে।

নিম্নলিখিত কারণে ডিমপাড়া মুরগির ডিমপাড়া কমে যেতে পারে :–

ত্রুটিপূর্ন্ ব্যবস্থাপনা

অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ

ত্রুটিপূর্ণ্ খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে খাদ্যে অতিরিক্ত ক্যালোরি ও চাহিদার চেয়ে কমপরিমান প্রোটিন গ্রহণ করলে খামারে পালিত মুরগির যকৃতে /লিভারে অতিরিক্ত ফ্যাট জমে। এতে খামারে পালিত মুরগির দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পায়। ফলে মুরগি ফ্যাটি লিভার সিন্ড্রোম রোগে ভোগে। এতে ডিমপাড়া মুরগির ডিমপাড়া হ্রাস পায়।

অনাকাংখিত/ আকস্মিক খাদ্য পরিবর্তন

ডিমপাড়া মুরগির ক্ষেত্রে খাদ্যে অনাকাংকিত বা আকস্মিক কোন পরিবর্ত্ন করা যাবে না। যারা মুরগিকে হঠাৎ করে এক কোম্পানী থেকে অন্য কোম্পানীর সরবরাহ করবে সেক্ষেত্রে মুরগির খাদ্য গ্রহণ হ্রাস পাবে এবং মুরগির আকস্মিকভাবে ডিমপাড়া কমে যাবে। আবার খাদ্যের মধ্যে বিশেষ করে যারা নিজ হাতে মিশিয়ে অথবা মিক্সিং মেশিনে মিশিয়ে খাদ্য তৈরি করে তারা যদি খাদ্যে প্রোটিনের আকস্মিক কোন পরিবর্ত্ন করে সেক্ষেত্রেও ডিমের উৎপাদন কমে যেতে পারে। এখানে প্রোটিনের পরিবর্ত্ন বলতে এক কোম্পানী থেকে অন্য কোম্পানীর প্রোটিন ।

অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ

সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় গুণগতমানের খাদ্য সরবরাহ না করলে মুরগি চাহিদানুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করবে না। এছাড়াও অতিরিক্ত গরমে মুরগির পানি গ্রহণের মাত্রা কেড়ে গেলে খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে যায়। ফলে ডিমপাড়া মুরগির দৈহিক ওজন হ্রাস পায় এবং ডিমের উৎপাদনও কমে যায়। তাই গরমের দিনে ডিমপাড়া মুরগিকে খুব সকালে ও শেষ বিকেলে খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস করাতে হবে।

নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ দেওয়া

খামারের মুরগিকে অবশ্যই ব্যালেন্সড ফিড/সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। পোল্ট্রি খাদ্য অবশ্যই আফলাটক্সিন মুক্ত হতে হবে। আফলাটক্সিন যুক্ত খাদ্য লিভার/যকৃতকে নষ্ট করে দেয় এমনকি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়। ফলে ডিমপাড়া মুরগির ডিমের উৎপাদন কমে যায়।

পানির স্বল্পতা ও বিশুদ্ধ পানির অভাব

ডিমপাড়া মুরগিকে পর্যাপ্ত পরিমানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ না দিলে ডিমের উৎপাদন ব্যহত হবে। সাধারণ তথ্য মতে, ৭০ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় মুরগি দৈনিক গ্রহণকৃত খাদ্যের ২.৫ গুণ বেশি পানি গ্রহণ করে। আবার ৭৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রার উপরে প্রতি ১ ডিগ্রী ফারেনহাইট বেশি তাপমাত্রার জন্য ৪% অতিরিক্ত পানি গ্রহণ করবে।মুরগি বেশী পানি গ্রহণ করলে খাদ্য গ্রহণের হার কমে যাবে এবং ডিমের উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে। অপরদিকে মুরগি স্বাভাবিকের তুলনায় কম পানি গ্রহণ করলেও ডিমের উৎপাদনে ধ্বস নেমে আসবে। তাই পোল্ট্রি খামারিকে খামারে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে সর্বদাই সতর্ক থাকতে হবে।

ত্রুটিপূর্ণ আলোকদান কর্মসূচি

ডিমপাড়া মুরগির ক্ষেত্রে একদিন বয়স (Day old chick/DOC) থেকেই আলোকদান কর্মসূচি যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। বিশেষ এক বাল্ব থেকে অন্য বাল্বের দূরত্ব,খামারের মেঝে থেকে বাল্বের উচ্চতা,বাল্বের ওয়াট ও বাল্বের ধরণের দিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা দরকার। এক্ষেত্রে খামারে আলোর তীব্রতা ও সময় (Lighting density & duration) হেরফের হলে ডিমপাড়া মুরগির ডিমপাড়া কমে যায়।

অপর্যাপ্ত বায়ু প্রবাহ

ডিমপাড়া মুরগির শেডে মুক্তভাবে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা অপরিহার্য । খামারে/শেডে মুক্তভাবে বায়ু চলাচলের অভাব থাকলে ডিসের উৎপাদন হ্রাস পাবে।তীব্র গরমের দিনে খামার/শেডের অভ্যন্তরে শীতল রাখার সুব্যবস্থা রাখা বাঞ্চণীয়। শীতকালে মুরগির খামারে বা শেডে পর্দা ব্যবহারের ফলে মুক্তভাবে বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্থ হলে খামারে এ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায় এবং খামারের অভ্যন্তরে অক্সিজেন লেভেল কমে গেলে মুরগি অসুস্থ হয় । ফলশ্রুতিতে খামারে ডিমের উৎপাদন ব্যহত হয়। মনে রাখা দরকার , তীব্র শীতের সময় শীতের তীব্রতা এড়াতে কোন ।অবস্থাতেই পলিথিন পেপার ব্যবহার করা যাবে না।

পুষ্টিকর খাদ্যের তারতম্য

প্রোটিন /এনার্জির ঘাটতি

সাধারনত ডিমপাড়া মুরগির ক্ষেত্রে প্রতি কিলোগ্রাম খাদ্যে প্রোটিন ১৮% এবং মেটাবলিক এনার্জি ২৭০০ কিলো ক্যারলারী দরকার। এর তারতম্য হলে মুরগির দৈহিক ওজন কমে যাবে এবং মুরগির উৎপাদন মারাত্মক ভাবে হ্রাস পাবে।

খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব

মুরগির দেহের মোট ক্যালসিয়ামের ৯০% এর বেশি ক্যালসিয়াম দ্বারা মুরগির হাড়/অস্থি (Bone) গঠিত। ক্যালসিয়ামের অভাবে ডিমপাড়া মুরগির পায়ে সমস্যা দেখা দেয় এবং মুরগি ঠিকমতো দ্বারাতে না পারলে সঠিক মাত্রায় খাদ্য গ্রহণে ব্যার্থ হয়। ফলে মুরগির ডিমপাড়া কমে যায় এবং ডিমের খোঁসা পাতলা হয়। ডিমপাড়া মুরগির ক্ষেত্রে , প্রতি ১০০ কিলোগ্রাম খাদ্যে ২৪ থেকে ৪০ সপ্তাহ বয়স পর্য়্ন্ত ১০০% ডিমের উৎপাদন থাকলে ৩.৩% ক্যালসিয়াম,৯০% উৎপাদন থাকলে ৩.০% ক্যালসিয়াম,৮০% উৎপাদন থাকলে ২.৭% ক্যালসিয়াম,৭০% ডিমরে উৎপাদন থাকলে ২.৩% ক্যালসিয়াম দরকার। আবার ৪০ সপ্তাহ বয়সের পর মুরগির ডিমের উৎপাদন ১০০% থাকলে ৩.৭% ক্যালসিয়াম,৯০% উৎপাদন থাকলে ৩.৩% ক্যালসিয়াম,৮০% উৎপাদন থাকলে ৩.০% ক্যালসিয়াম এবং ৭০% উৎপাদন থাকলে ২.৬% ক্যালসিয়াম দরকার।

খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ

মুরগির খাদ্য অথবা খাবার পানিতে অতিরিক্ত লবণ থাকলে লবণজণিত বিষক্রিয়া ও এ পানি গ্রহণ করলে মুরগির অন্ত্রে ক্ষতের সৃষ্টি হবে। এতে মুরগি ডিহাইড্রেশনে ভোগবেএবং মুরগি মারা যেতে পারে। আবার মুরগির খাদ্যে লবণের পরিমান কম হলে মুরগির খাদ্য গ্রহণ কমে যাবে এবং ডিমরে উৎপাদনও হ্রাস পাবে।

খাদ্যে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব

ডিমপাড়া মুরগির ক্ষেত্রে, ভিটামিন ও মিনারেল/খনিজ রবণ নানাভাবে কাজে লাগে। মুরগির দৈহিক ওজন বৃদ্ধি,হাড়ের গঠন,পালক গজাঁনো ও পালকের সুবিণ্যাস,খাদ্য গ্রহণের আগ্রহ ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি সহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে। এছাড়াও ডিমের উর্ব্বরতা বৃদ্ধি,প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও হরমোন নিঃসরণ করতে সহায়তা করে। পোল্ট্রি খাদ্যে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবজনিত কারণে মুরগির ডিমের উৎপাদন,ডিমের খোঁসার গঠন,ডিমের খোঁসার রং ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা দেখা দিবে।

সংক্রামক রোগ

যে কোন ধরণের সংক্রামকজনিত রোগে আক্রান্ত হলে মুরগির প্রাণহানী ঘটে। মুরগি বেশিদিন রোগে ভোগলে মুরগির দৈহিক ওজন হ্রাস পায়,ডিমর উৎপাদন কমে যায়; এমনকি মুরগি মারাও যায়। মুরগির ডিমের উৎপাদন কমতে নিম্ন বর্ণীত রোগ সমূহ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত –

ক) ক্রোনিক এন্টেরাইটিস,

খ) সিআরডি –মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হলে ১০% ডিমের উৎপাদন কমে যায়,

গ) কক্সিডিওসিস,

ঘ) ই ডি এস — মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হলে ডিমের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ডিমের খোঁসা পাতলা হবে,

ঙ) ফাউল পক্স — সামান্য পরিমানে ডিমের উৎপাদন ব্যহত হয়,

চ) ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস — এ রোগে ডিমপাড়া মুরগি আক্রান্ত হলে ১০ থেকে ১৫% ডিমের উৎপাদন ব্যহত হয় এবং ডিমের খোঁসা নরম ও পাতলা সহ ডিমের এ্যালবুমিন পানসে হয়ে যায়,

ছ) ইনফেকশাস কোরাইজা এ রোগে আক্রান্ত মুরগির মাথা ফুলে যায় এবং তীব্র সর্দি কাশিতে ভোগে। ডিমপাড়া মুরগি আক্রান্ত হলে খাওয়া ছেড়ে দেয় । ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়,

জ) রানীক্ষেত রোগ— ডিমপাড়া মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হলে ডিমের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় এবং ডিসের খোঁসার রং ফ্যাকাশে ও পাতলা সহ নরম হয়,

ঝ) এডিনো ভাইরাস ইনফেকশন ।

পরজীবীর উপদ্রব

ডিমপাড়া মুরগির পরজীবী বলতে মাইট (Mites infestation) ,উকুন (Lice infestation) ,কৃমি (Worm infestation) ও কক্সিডিওসিস রোগে আক্রান্ত হওয়াকে বোঝায়। যে সমস্ত পোল্ট্রি খামারে লিটার পদ্ধতিতে ডিমের মুরগি পালন করা হয় সে সমস্ত পোল্ট্রি খামারে পরজীবীর উপদ্রব তুলনামূলকভাবে বেশি। মুরগি যে কোন ধরণের পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হলে মুরগির খাওয়ার রুচি কমে যাবে ও অসুস্থ হবে এবং মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে ।এছাড়াও মুরগির দৈহিক ওজর হ্রাস পাবে ও ডিমের উৎপাদন ব্যহত হবে। ৫।

জলবায়ুর অবস্থা

ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতুভেদে বাংলাদেশের তাপমাত্রা পরিবর্ত্ন হয়। তীব্র শীতে বাতাসের তাপমাত্রা কমে গিয়ে কোন কোন বৎসর কোন কোন এলাকায় ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার নীচে চলে আসে । আবার অতি তীব্র গরমে বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে ওঠে। অবশ্য এলাকা ভেদে শীত বা গরম কালে বাতাসের তাপমাত্রা কম বা বেশী হতে পারে। বাতাসের তাপমাত্রা /আর্দ্রতা পরিবর্ত্ন জনিত কারণে খামারের মুরগি ধকলে (Stress) আক্রান্ত হলে মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবে,রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে,মুরগির দৈহিক ওজন কমে যাবে এবং অবশেষে ডিমপাড়া মুরগির ডিমপাড়পা বহুলাংশে কমে যাবে।

উল্লেখ্য যে, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হলে মুরগি বেশি পরিমানে পানি খাবে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে গেলে মুরগির খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে যাবে, তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে গেলে বেশি গরমে মুরগি হাপাতে শুরু করবে, তাপমাত্রা ৪০ ডগ্রিী সেলসিয়াসের কাছাকাছি গেলে মুরগি মারা যেতে শুরু করবে, তবে জেনে রাখা ভারো যে, তাপমাত্রা ১৮.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ২১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে মুরগি সবচেয়ে বেশি আরামদায়ক অনুভূতি অনুভব করে এবং খামারের মুরগি সুস্থ থাকে।

মুরগিকে টিকা প্রদান ও কৃমিনাশক সেবন করানো

মুরগিকে সুস্থ রাখার নিমিত্বে নিয়মিত টিকা প্রদান ও কৃমিনাশক সেবন করানো একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে মুরগিকে টিকা প্রদান ও কৃমিনাশক সেবন করালে মুরগি ধকল বা পীড়নে আক্রান্ত হয়। অবশ্য এ সব ধকল/পীড়ন কোনভাবেই এড়ানোযোগ্য নয়। মুরগিকে টিকা প্রদান ও কৃমিনাশক সেবন জনিত ধকল/পীড়নের ফলে ডিমপাড়া মুরগির বারবার ডিমের উৎপাদন হোঁচট খায়।