হবিগঞ্জে বিজনা নদীতে ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরা উৎসব

542

মাছ-ধরা

হবিগঞ্জ : জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার পানিউমদা ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত বিজনা নদীতে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে দুপুর পর্যন্ত এই মাছ ধরা উৎসবে দেশীয় উপকরণ পলো এবং বিভিন্ন জাল নিয়ে অংশ নেন ৩ শতাধিক লোকজন।

পানি উমদা গ্রামের যুবক অনু আহম্মেদ জানান, বিজনা নদীতে শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য হল এই মাছ শিকার উৎসব। পানিউমদা ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের লোকজন প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দিনে এই উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। পানিউম্দা,কুর্শা, বড়কান্দি, বড়গাঁও, বুড়িনাও (পাঁচগ্রাম) গ্রামের মুরুব্বিরা বৈঠক করে প্রতি বছর এই উৎসবের তারিখ করেন। পরে এক সাথে বিজনা নদীতে পলো এবং জাল দিলে মাছ ধরেন সবাই মিলে। এই ধারাবাহিকতায় এ বছরও মঙ্গলবার আয়োজন করা হয় এই উৎসব।

বিজনা নদীতে মাছ ধরার জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে প্রস্তুতি নিতে থাকেন ৫ গ্রামের জনগন। নির্ধারিত দিনে কয়েক হাজার লোক পলো, জাল,দড়িসহ মাছ শিকারের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে বিলে হাজির হন। মাছ শিকার উৎসব উপলক্ষে ওই গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসব মুখর পরিবেশ। উপকরণ তৈরি ও প্রস্তুত করে মঙ্গলবার সকাল ৭টায় বিজনা নদীর নোয়াগাঁও সীমানা থেকে মাছ ধরা শুরু হয়। শেষ হয় ইলামপুর এসে। প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক ঝাঁপ দেওয়া আর হৈ হুল্লোর করে সামনের দিকে ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় এক দৃশ্য দেখা যায় বিজনা নদীতে।

শিকারীদের অনেকেই বোয়াল, গজার, শোলসহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরেন। অনেকেই একাধিক মাছ ধরতে পারলেও শুন্য হাতেও ফিরেছেন কেউ কেউ। কয়েক লাখ টাকার মাছ শিকার করেন সবাই মিলে। মাছ ধরা পড়ার সাথে সাথে তাদের আনন্দে শরীক হন পাশের লোকজন। মাছ শিকার উৎসবে পলো ছাড়াও ফার জাল, ছিটকি জাল, ঝাকি জাল, পেলুন ইত্যাদি দিয়েও মাছ শিকার করেন অনেকে।

বড়কান্দি গ্রামের আলত মিয়া পলো দিয়ে দুটি বড় বোয়াল মাছ ধরেন। মাছ দুটির দাম হবে ২ হাজার টাকা। তিনি জানান, পলো দিয়ে মাছ শিকারের আনন্দই আলাদা। তিনি হাসি মুখে মাছ দুটি নিয়ে বাড়ী ফিরেন।
বুড়িনাও গ্রামের সুমন মিয়াও ছোট বড় কয়েকটি মাছ নিয়ে বাড়ী ফিরেন। তার এক হাতে ছিল পলো আর এক হাতে শিকার করা মাছ।

পানিউম্দা গ্রামের প্রবীণ মুরুব্বি ধনু মিয়া( ৯৫) বলেন, ছোট বেলায় বাপ-চাচাদের সাথে যখন বিজনা নদীতে যেতাম তখন অনেক মাছ পাওয়া যেত। এখন তেমন মাছ দেখা যায় না।

শংকরপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা ধনেশ্বর বিশ্বাস (ইউ/পি সদস্য) বলেন -উজান এলাকার মানুষ প্রতি বছর একসাথে মাছ ধরাত আইলে অনেক ভাল লাগে। এবারও সুন্দরভাবে শেষ হয়েছে মাছ ধরা উৎসব।

পানিউমদা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইজাজুর রহমান জানান, তার বয়স এখন ৭০। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেন এই উৎসব। উৎসবের বয়স ১শ বছরের বেশি হবে বলে জানান তিনি। তবে এখন যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় এক সময় এর চেয়ে বেশী এবং বড় মাছ পাওয়া যেত। ছোট বেলায় তিনি দেখেছেন পলো এবং জাল দিয়ে বোঝাই করে মাছ শিকার করে আনতেন লোকজন।

তিনি আরও জানান, প্রতিবছর ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পলো দিয়ে মাছ শিকার অনুষ্ঠিত হয়। এলাকাবাসী এটি আনন্দ উৎসব হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বাইর থেকেও অনেক লোক আসে এই উৎসবে।

হবিগঞ্জের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাদা খসরু বলেন, হবিগঞ্জের হাওর গুলোতে এবার ভালই মাছ উৎপাদন হয়েছে। পলো সহ দেশীয় উপকরণ দিয়ে মাছ শিকার করলে যেমন খরচ কম তেমনি মাছের বংশ বিনাশ হয় না। হবিগঞ্জের হাওর গুলোতে মাছ শিকারের জন্য পলোর ব্যবহার হয়ে আসছে বহু পুরনো কাল থেকে। বাঁশের তৈরি এই পলো মাছ শিকারসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন কৃষকরা।