পেঁপে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ফসল। বাংলাদেশে পেঁপে চাষ খুবই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। হাইব্রীড পেঁপের কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে- প্রথমত এটা স্বল্প মেয়াদী, দ্বিতীয়ত ইহা কেবল ফলই নয় সব্জী হিসেবেও এর ব্যপক ব্যবহার রয়েছে, তৃতীয়ত পেঁপে অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং ঔষধী গুণ সম্পন্ন।পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি ও আয়রন বিদ্যমান। কাঁচা পেঁপেতে পেপেইন নামক হজমকারী দ্রব্য থাকে।
হাইব্রিড পেঁপে চাষের জন্য কিছু জাতঃ
রেড লেডী
এই জাতের ফলগুলি বেশ বড়। পুরুষ গাছ হয় না। ফলের রং লাল-সবুজ। এক একটি ফলের ওজন ১.৫ থেকে ২ কেজি। মাংস বেশ পুরু, শক্ত, গাঢ় লাল, স্বাদে বেশ মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত। গাছের উচ্চতা ১.৫০ ফুট হলেই ফল ধরা শুরু করে। চারা লাগানোর ৫০-৬০ দিনেই ফুল ধরা শুরু হয়। প্রতিটি গাছে গড়ে ৫০-১২০টির অধিক ফল ধারন করে। এই জাতের পেঁপে গাছ রিং স্পট ভাইরাস রোগে সহ্য ক্ষমতা আছে।
নোউন ইউ নং-১
এই হাইব্রীড জাতিটিও অধিক উৎপাদনশীল এবং এটাও রিং স্পট ভাইরাস রোগ সহ্য ক্ষমতা সম্পন্ন। এ জাতীয় গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধারন করে। ফল বেশ বড়, প্রতিটি ওজন ১.৬ কেজি, মাংস হলুদ বর্ণের, আকারে লম্বা এবং মিষ্টি সুস্বাদু।
মধুবিন্দু
গোলাকার ফল আকারে বড়। কান্ডে ও বৃন্তে কোন দাগ নেই। তাড়াতাড়ি ফলে এবং ফলনও খুব বেশী। অত্যন্ত মিষ্টি ও ভাল গন্ধ আছে। ফলগুলোর খোসা মোটা হওয়াতে পরিবহনে বিশেষ উপযুক্ত।
হাইব্রিড পেঁপে চাষ করার জন্য নির্বাচন ও তৈরীঃ
পেঁপে গাছ মোটেও জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই পেঁপের জন্য নির্বাচিত জমি হতে হবে জলাবদ্ধতা মুক্ত এবং সেচ সুবিধাযুক্ত। জমি বারবার চাষ ও মই দিয়ে উত্তমরূপে তৈরী করতে হবে। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে বেড পদ্ধতি অবলম্বন করা উত্তম। পাশাপাশি দু’টি বেডের মাঝে ৩০সে.মি চওড়া এবং ২০সে.মি. গভীর নালা থাকবে। নালাসহ প্রতিটি বেড ২মিটার চওড়া এবং জমি অনুযায়ী লম্বা হবে।
হাইরবিড পেপের চারা তৈরীঃ
বীজ থেকে বংশ বিস্তার করা যায়। বীজের প্যাকেট কেটে ২ ঘন্টা রোদে শুকানোর পর ২ ঘন্টা ঠান্ডা জায়গায় রেখে, ঠান্ডা করে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা পানিতে ভেজানোর পর পলেথিন ব্যাগে চারা তৈরী করতে হবে। পলিথিনে ব্যাগে চারা তৈরী করলে রোপনের পর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ৫×৬ সেঃমিঃ আকারের ব্যাগে সমপরিমান বেলে দোআশ মাটি ও পঁচা গোবরের মিশ্রণ ভর্তি করে, ব্যাগের তলায় ২-৩ টি ছিদ্র করতে হবে। তারপর এতে সদ্য সংগৃহীত বীজ হলে ১টি এবং পুরাতন বীগ হলে ২টি বীজ বপন করতে হবে। একটি ব্যাগে এক এর অধিক চারা রাখা উচিৎ নয়।
বীজ ও চারার পরিমাণঃ
হেক্টর প্রতি ৭০-৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন। প্রতি গ্রামে বীজের সংখ্যা ৬৫-৮০ টি। সে হিসেবে ৩০০০-৩২০০ চারা দিয়ে ১ হেঃ জমিতে পেঁপের চারা লাগানো যায়।
গর্ত তৈরীঃ
চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পূর্বে বেডের মাঝ বরাবর ২ মিটার দূরত্বে ৬০x৬০x৬০ সে.মি. আকারে গর্ত তৈরী করতে হবে। গর্ত প্রতি ১৫ কেজি পঁচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম এমওপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম জিপসাম, ৩০ গ্রাম বোরাক্স এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট (মুক্তাপ্লাস) সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মেশাতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি দ্বারা গর্ত পূরণ করে সেচ দিতে হবে।
বীজ বপন ও চারা রোপণের সময়ঃ
আশ্বিন এবং পৌষ মাস হল পেঁপের বীজ বপনের উত্তম সময় এবং বীজ বপনের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর অর্থাৎ মাঘ-ফাল্গুণ মাসে চারা রোপণের উপযোগী হয়। তবে হাইব্রীড পেঁপে সারা বছর লাগানো যায়। উত্তম সময় হলো ফেব্রুয়ারি থেকে মে এবং সেপ্টম্বর-অক্টোবর।
চারা রোপণঃ
চারা রোপণের আগে গর্তের মাটি ভালভাবে উলটপালট করে নিতে হবে। প্রতি গর্তে ১টি করে চারা রোপণ করতে হবে। পলিব্যাগে উৎপাদিত চারার ক্ষেত্রে পলিব্যাগটি খুব সাবধানে অপসারণ করতে হবে, যাতে মাটির বলটি ভেঙ্গে না যায়। পড়ন্ত বিকেল চারা রোপণের জন্য উত্তম সময়। রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে চারার গোড়া বীজতলা বা পলিব্যাগে মাটির যতটা গভীরে ছিল তার চেয়ে গভীরে না যায়।
গাছে সার প্রয়োগঃ
ভাল ফলন পেতে হলে পেঁপেতে সময় মতো সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি গাছে ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের দুই মাস পর হতে প্রতিমাসে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছে ফুল আসার পর এই মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে। মাটিতে রসের অভাব হলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিচর্যাঃ
পেঁপের জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। বর্ষা মৌসুমে আগাছা দমন করতে গিয়ে মাটি যাতে বেশি আলগা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
পানি সেচ ও নিষ্কাশনঃ
শুষ্ক মৌুমে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি সেচ দিতে হবে। সেচের ও বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে জন্য পানি নিকাশের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
ফল পাতলা করণঃ
পেঁপের অধিকাংশ জাতের ক্ষেত্রে একটি পত্রক থেকে একাধিক ফুল আসে এবং ফল ধরে। ফল কিছুটা বড় হওয়ার পর প্রতি পত্রকক্ষে সবচেয়ে ভাল ফলটি রেখে বাকিগুলো ছিড়ে ফেলতে হবে। দ্বিতীয় বা তার পরবর্তী বছরে যে পেঁপে হয় সেগুলো ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে। ফলে ঠিকমত বাড়তে পারেনা এবং এদের আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ছোট ফলগুলো ছাঁটাই করতে হবে।
হাইরবিড পেঁপে চাষে রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনঃ
পেঁপের রোগবালাইয়ের মধ্যে ঢলেপড়া ও কাণ্ডপঁচা, এ্যানথ্রাকনোজ, মোজাইক ও পাতা কোঁকড়ানো রোগ অন্যতম। আর পোকার মধ্যে মিলিবাগ উল্লেখযোগ্য।
ঢলেপড়া ও কাণ্ডপঁচা রোগঃ
মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে বীজতলায় চারায় ঢলে পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়া বর্ষাকালে কাণ্ডপঁচা রোগ দেখা দিতে পারে। কাণ্ডপঁচা রোগ হলে গাছের গোড়ায় বাদামী বর্ণের পানি ভেজা দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত চারা গাছ মারা যায় এবং ঢলে পড়ে। প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা হিসেবে বীজতলার মাটি বীজ বোনার আগে শুকনা রাখতে হবে এবং প্রোভেক্স নামক ছত্রাক নাশক ২ থেকে ৩ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করতে হবে। এ রোগের প্রতিকার হিসেবে রোগাক্রান্ত চারা গাছ উঠিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ০৪ গ্রাম একরোবেট এমজেড বা ০১মিলি স্কোর বা ০১মিলি কোগার ২৮এসসি ছত্রাকনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত কাণ্ডে ছিটিয়ে দিলে সুফল পাওয়া যায়।
এ্যানথ্রাকনোজঃ
এ রোগের কারণে ফলের গায়ে বাদামী পচন রোগ দেখা দেয়। ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ
০৪ গ্রাম একরোবেট এমজেড বা ০১ মিলি কোগার ২৮ এসসি বা ০২ মিলি ডিফেন্স ৩৫এসসি বা ২ গ্রাম নোইন নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩বার ফলে গায়ে স্প্রে করতে হবে।
পেঁপের মোজাইক ভাইরাসঃ
এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। এ রোগ হলে পাতায় হলুদ রং এর ছোপ ছোপ দাগ পড়ে, পাতার বোঁটা বেঁকে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। জাব পোকা ও সাদামাছি এ রোগ ছড়ায়।
প্রতিকারঃ
আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগ বিস্তারকারী জাব পোকা ও সাদামাছি দমনের মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। এজন্য নোভাস্টার ৫৬ইসি ০২ মিলি বা হেমিডর বা পিমিডর বা কনফিডর ৭০ডব্লিউজি ০২গ্রাম বা ইমিটাফ বা এডমায়ার ২০০ এসএল ০১ মিলি প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৫ থেকে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
মিলিবাগঃ
সাম্প্রতিক সময়ে মিলিবাগ পেঁপের একটি ক্ষতিকর পোকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আক্রান্ত পাতা ও ফলে সাদা পাউডারের মতো আবরণ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের পাতা ও ফল শুটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছ মারা যেতে পারে।
প্রতিকারঃ
আক্রমণের প্রথম দিকে পোকাসহ আক্রান্ত পাতা বা কাণ্ড সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম সাবান পানি অথবা নোভাস্টার ৫৬ইসি ০২ মিলি বা হেমিডর বা পিমিডর বা কনফিডর ৭০ডব্লিউজি ০২গ্রাম বা ইমিটাফ বা এডমায়ার ২০০ এসএল ০.৫০ মিলি প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৫ থেকে ৭ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
ফল সংগ্রহঃ
সবজি হিসেবে ব্যবহারের জন্য ফলের কষ যখন হালকা হয়ে আসে এবং জলীয়ভাব ধারণ করে তখন পেঁপে সংগ্রহ করতে হবে। অন্যদিকে ফলের গায়ে যখন হালকা হলুদ রং দেখা দেবে তখন ফল হিসেবে সংগ্রহ করতে হবে।
ফলনঃ
উপযুক্ত যত্ন নিলে পেঁপে চাষে হেক্টর প্রতি ৮০ থেকে ১০০ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২১ফেব্রু২০২০