হাজার বছরের পুরনো বীজ থেকে উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন সম্ভব

395

1502382948

নিলয় মামুন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে: হাজার বছরের প্রাচীন বীজ থেকে উচ্চ ফলনশীল জাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাচীন বীজ থেকে কৃষি ইতিহাস, অধিক ফলনশীল ফসল উত্পাদনের কৌশল ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ উদঘাটনের এক নতুন ল্যাবরেটরি। যেখানে গবেষণার মাধ্যমে জানা যাবে হাজার বছর পূর্বে এই অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা ও জলবায়ু সম্পর্কেও। যার মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও জলবায়ুর ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।

Laboratory of palaeoethnobotany and palaeoecology নামে বাংলাদেশে প্রথম প্রাচীন উদ্ভিদ ও জলবায়ু গবেষণার ল্যাবটি গড়ে তুলেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তরুণ শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান (জামী)। যিনি ২০১৩ সাল থেকে এই ল্যাবের কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও হেকেপ এর আংশিক আর্থিক সহযোগিতায় ল্যাবটিতে গবেষণা চলছে।

এক সময় বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করতেন বাংলাদেশের মতো এমন আবহাওয়ার দেশে প্রাচীন উদ্ভিজ্জ দীর্ঘদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করে মিজানুর রহমান ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১৪টি প্রত্নস্থান থেকে প্রাচীন উদ্ভিজ্জ নমুনা হিসেবে বীজ, ফাইটোলিথ, পলেন ও ডায়াটমের প্রায় ৫০০০ নমুনা সংগ্রহ করেছেন। মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পর যে মাটি বের হয়ে আসে সেখান থেকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় প্রতিটি স্তর ও প্রেক্ষিত হতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কিছু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মাটি সংগ্রহ করতে হয়।

এই মাটি পানিতে ভিজিয়ে ফ্লোটেশন মেশিনের মাধ্যমে মাটির ভেতরে থাকা হাজার হাজার বছরের প্রাচীন উদ্ভিজ্জ নমুনাসমূহ আলাদা করে Macro remains গুলো আলাদা করা হয়। এ সকল নমুনা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ল্যাবের পাশাপাশি সহযোগী গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে University College London (UCL) এর Laboratory of Archaeobotany and Palaeoecologyতে এ বিষয়ে গবেষণা চলছে। নমুনা সংগ্রহে সহায়তা করছে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণ, Hunan provincial institute of archaeological relics এর প্রত্নতাত্ত্বিক দল এবং মহাস্থানগড়ে কর্মরত ফ্রান্স প্রত্নতাত্ত্বিক দল।

প্রত্ন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এর মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাচীন শস্য বীজের ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করে শস্যের নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। তাদের ধারণা এ ধরনের গবেষণা ফলপ্রসূ হলে বর্তমানে বিঘাপ্রতি যেখানে ২০ মণ ধান উত্পাদন হয় সেখানে তা বেড়ে তিনগুণ পর্যন্ত হয়ে যাবে। শুধু ধান নয়, ভবিষ্যতে গম, ডাল, তেলবীজ, কটন, জুট ও ফলসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলও উত্পাদন হবে এই প্রক্রিয়ায়।

পলেন, ডায়াটম, ফাইটোলিথ, প্রত্ন পলল ও প্রত্ন বীজকে বলা হয় প্রাচীন পরিবেশের তথ্য ভান্ডার। এ সকল উপাদান লক্ষ লক্ষ বছর মাটির নিচে টিকে থাকতে পারে। ফলে প্রত্নস্থান থেকে এ সকল উপাদানের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণার ফলে উন্মোচিত হতে পারে বাংলাদেশের প্রাচীন জলবায়ু ও এর পরিবর্তনের সূচক।

আধুনিক জলবায়ুর পরিবর্তন বোঝা ও তা মোকাবেলার কৌশল প্রণয়নে এটি হয়ে উঠতে পারে মাইল ফলক। UCL Institute of Archaeology’র প্রত্নউদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রফেসর ডোরিয়ান ফুলারের মতে, এই প্রথমবারের মতো আমরা বাংলাদেশের প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থার (Hardcore evidence) প্রামাণ্য নমুনা পেলাম। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রাচীন উদ্ভিদ গবেষণার ফলে প্রাপ্ত ফলাফল বাংলাদেশের কৃষি গবেষকদের জন্য মাইলফলক হবে। ইতোমধ্যে ট্রাইনোকুলার স্টেরিও মাইক্রোস্কোপ, ফ্লোটেশন মেশিনসহ বেশ কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ল্যাবরেটরিতে সংযুক্ত করা হয়েছে।

মিজানুর রহমান জানান, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন হতে সংগ্রহ করা তিন শতাধিক প্রাচীন রেফারেন্স উদ্ভিজ নমুনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ল্যাবটিতে ইংল্যান্ড, জার্মানি, কানাডা ও বেলজিয়াম থেকে প্রত্নউদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ কাজ করেছেন। এ বিষয়ে ২টি গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা তরুণ এই প্রত্নউদ্ভিদ বিজ্ঞানী।

মিজানুর রহমান জানান, তিনি লন্ডনের University College London (UCL) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এ ল্যাব গড়ে তুলে গবেষণার কাজ পরিচালনা করছেন। তবে ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠায় প্রাথমিক পর্যায়ে সাফল্য পেলেও দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই গবেষণা সাফল্যের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। বিশেষ করে গবেষকদের দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিং এবং এমএস/পিএইচডি প্রোগ্রামে পাঠানোর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে বাংলাদেশের প্রাচীন শস্য ও জলবায়ু গবেষণা অচিরেই একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টি বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে এটি কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের অংশ। বর্তমান ল্যাবরেটরিটি প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞান চর্চায় একধাপ এগিয়ে গেল। যেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান এমনকি শ্রীলংকাও এ ধরনের গবেষণায় বেশ এগিয়ে গেছে সেখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খুব দ্রুতই বাংলাদেশ এ ধরনের গবেষণায় অন্য দেশগুলোকে টপকে যেতে পারবে বলে আশা করেন তিনি।

এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যে বিষয়ে গবেষণা চলছে, তার নমুনা ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। আশা করা যায় এই নমুনা দিয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

এই খাতে আর্থিক সহায়তা সম্পর্কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, প্রতি বছর আমরা বিভিন্ন গবেষণা খাতে বরাদ্দ দিয়ে থাকি। উপযুক্ত গবেষণা কার্যক্রম চললে প্রজেক্ট সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দিলে আমাদের এসব খাতে বরাদ্দ দেয়ার আগ্রহ আছে। কৃতজ্ঞতা: ইত্তেফাক

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম