নেত্রকোনার মদন উপজেলার তিয়শ্রী ইউনিয়নের হ্যাচারি পল্লী নামে পরিচিত কোঠুরীকোনা গ্রাম। হারিকেনের আলোতে হাঁসের বাচ্চা ফোটানো গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের পেশা। তুষ ও হারিকেন পদ্ধতিতে প্রতিদিনেই ফুটছে হাঁসের লক্ষাধিক বাচ্চা। আর এই হাঁসের বাচ্চা দেশে-বিদেশে বিক্রি করা হয়।
কিন্তু করোনার কারণে এখন আর দেশের বাহিরে তাদের ফোটানো বাচ্চা বিক্রি করতে পারেন না। তবে প্রতিদিনেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রেতারা ভিড় জমায় হ্যাচারি পল্লীতে। প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই হ্যাচারি পল্লীর লোকজন। অনলাইনে অর্ডার করলেও নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে যায় হাঁসের বাচ্চা।
প্রাকৃতিক উপায়ে মুরগী ডিমে তাপ দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। সেখান থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর যন্ত্র ইনকিউবেটরের আবিষ্কার। ব্যবসার জন্য একসঙ্গে অধিক পরিমাণে ডিম ফোটানোর ক্ষেত্রে ইনকিউবেটরের বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ। কিন্তু কোঠুরীকোনা হ্যাচারি পল্লী হাওরাঞ্চল হওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হতেই থাকে। তাছাড়া অনেকের এই যন্ত্রটির কেনার সামর্থ্য না থাকায় তারা এটি ব্যবহার করতে পারছেন না। তাই তারা তুষ ও হারিকেনের আলোতে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে ভাগ্যের চাকা বদল করেছেন। প্রথমে ভালো জাতের হাঁসের ডিম সংগ্রহ করেন হ্যাচারি খামারিরা।
ডিম সংগ্রহের পর সেগুলো পানিতে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। এর পর বাছাই করা ডিম মাটি বা ইটের তৈরি পাকা ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচায় সারিবদ্ধভাবে রেখে তোশক বা মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। মাচার নিচে হারিকেন বসিয়ে পরিমাণমতো তাপ দেওয়া হয়। ২৫ দিন পর ডিমগুলো ফুটতে শুরু করলে কাপড়ের আবরণ তুলে নেওয়া হয়। ২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। প্রতিটি একদিন বয়সের হাঁসের বাচ্চা ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হয়। উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদনের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ছোট হলেও এসব উদ্ভাবন দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। এগুলো মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনেও সহায়ক বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
এক সময় ওই গ্রামের লোকজন কাজের সন্ধানে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতেন। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটত তাদের। ১৯৯০ সালের দিকে কোঠুরীকোনা গ্রামের আক্কেল আলীর ছেলে হাদিস মিয়া প্রথমে নিজ বাড়িতে তুষ ও হারিকেনের আলোর পদ্ধতিদে ডিম থেকে হাঁসের বাচ্চা ফুটানো শুরু করেন। পরে গ্রামের শতাধিক লোকজন হাদিস মিয়ার সহযোগিতায় ওই পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এ গ্রামে বেকার বলতে কাউকে চোখে পড়ে না। প্রত্যেকটি পরিবারে ছেলে-মেয়েরা ওই পেশায় নিয়জিত রয়েছেন। এরি মধ্যে স্বাবলম্বী হয়েছেন গ্রামের অধিকাংশ পরিবার। হ্যাচারি পল্লী কোঠুরীকোনার ইয়াসিন মিয়া এ পদ্ধতি শিখে স্বপ্ন জয় করেছেন।
ইয়াসিন মিয়া বলেন, আমার স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সাত সদস্যের পরিবার। কাজের সন্ধানে এক সময় এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। ভাগ্য ফেরাতে বড় ভাই হাদিস মিয়া আমাকে হাঁসের ডিম ফোটানোর ব্যবসা শুরুর পরামর্শ দেন। এরপর তার সহযোগিতায় এক হাজার ডিম কিনে তুষ ও হারিকেনের আলোয় বাচ্চা ফুটিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে তা বিক্রি করি। লাভজনক হওয়ায় উৎপাদন দিন দিন বাড়াতে থাকেন। পরে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা এসে আমার কাছ থেকে এক দিন বয়সের হাঁসের বাচ্চা কিনে তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতে থাকেন। বাংলাদেশ প্রাণী গবেষণা কেন্দ্রসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি দল আমার হ্যাচারি খামার পরিদর্শন করেন।
তারা পদ্ধতি উন্নয়নের পরামর্শ দিলে সেই পরামর্শ অনুযায়ী ডিম থেকে হাঁসের বাচ্চা ফোটাতে শুরু করি। এর পর থেকেই আমার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। একপর্যায়ে ভারতের মেঘালয় এবং নেপালে আমাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমি ৪/৫শ’ হাঁস খামারিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরপরই বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা কেন্দ্র এবং ভারতের মেঘালয় বেসিন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এমবিডিএ)’র কাছ থেকে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের সনদপত্র পাই।
তিয়শ্রী ইউপি চেয়ারম্যান ফখর উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোঠুরীকোনা গ্রামের মানুষের পেশা হাঁসের বাচ্চা ফোটানো। এ গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখন স্বাবলম্বী। এ পেশার লোকজনের উন্নতির জন্য সরকারের দৃষ্টি কামনা করছি।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মাসুদ করিম সিদ্দিাকী বলেন, কোঠুরীকোনা গ্রাম হ্যাচারী পল্লী হিসাবে পরিচিত। এ গ্রামের ছোট বড় সব বয়সের মানুষ তুষ ও হারিকেনের পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটাতে পারেন। আমরা বিভিন্ন সময়ে এ গ্রামের লোকজনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
নেত্রকোনার মদন উপজেলার কোঠুরীকোনা গ্রামের লোকজন হাসের বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম প্রস্তুত করছেন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৭ অক্টোবর ২০২১