উন্নত পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ , ফলন হবে দীগুণ

2301

পেঁপে বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান ফল। কাঁচা পেঁপে সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে পেঁপের চাষ করা হয়। পুষ্টিমানে অত্যন্তÍ সমৃদ্ধ এই ফল মানব দেহে রোগ প্রতিরোধে কাজ করে। পেঁপে স্বল্প মেয়াদী ফল, এর চাষের জন্য বেশি জায়গারও প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আঙ্গিনায় দু’চারটি গাছ লাগালে তা থেকে সারা বছর সবজি ও ফল পাওয়া যায়।

পুষ্টিমান: পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি ও আয়রন বিদ্যমান। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য পাকা পেঁপেতে ৮৮.৪ ভাগ জলীয় অংশ, ০.৭ গ্রাম খনিজ, ০.৮গ্রাম আঁশ, ১.৯ গ্রাম আমিষ, ০.২ গ্রাম চর্বি, ৮.৩ গ্রাম শর্করা, ৩১.০ মি.গ্রা.লৌহ, ০.০৮ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-১, ০.০৩ মি.গ্রা. বি-২, ৫৭.০ মি.গ্রা. ভিটামিন সি, ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন ও ৪২ কিলোক্যালরী খাদ্য শক্তি রয়েছে।

ওষুধিগুণ: অজীর্ণ, কৃমি সংক্রমণ, আলসার, ত্বকে ঘা, একজিমা, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা ডিপথেরিয়া, আন্ত্রিক ও পাকস্থলীর ক্যানসার প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে কাঁচা পেঁপের পেপেইন ব্যবহার করা হয়। পেঁপের আঠা ও বীজ কৃমিনাশক প্লীহা যকৃতের জন্য উপকারী।

জাত: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৯২ সালে শাহী নামের একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে। জাতটির বৈশিষ্ট্য হলো- এটি একটি একলিঙ্গী জাত। গাছের উচ্চতা ১.৬ থেকে ২.০ মিটার। কাণ্ডের খুব নিচু থেকে ফল ধরে। ফল ডিম্বাকৃতি এবং ওজন ৮০০থেকে ১০০০ গ্রাম। ফল প্রতি বীজের সংখ্যা ৫০০ থেকে ৫৫০ টি। রং গাঢ় কমলা থেকে লাল। ফল বেশ মিষ্টি ও সুস্বাদু। গাছ প্রতি ফলের সংখ্য ৪০ থেকে ৬০টি। জাতটি দেশের সব জায়গায় চাষ উপযোগী।

জমি নির্বাচন ও তৈরী: পেঁপে গাছ মোটেও জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই পেঁপের জন্য নির্বাচিত জমি হতে হবে জলাবদ্ধতা মুক্ত এবং সেচ সুবিধাযুক্ত। জমি বারবার চাষ ও মই দিয়ে উত্তমরূপে তৈরী করতে হবে। দ্রুত পানি নিকাশের সুবিধার্থে বেড পদ্ধতি অবলম্বন করা উত্তম। পাশাপাশি দু’টি বেডের মাঝে ৩০সে.মি চওড়া এবং ২০সে.মি. গভীর নালা থাকবে। নালাসহ প্রতিটি বেড ২মিটার চওড়া এবং জমি অনুযায়ী লম্বা হবে।

চারা তৈরী: পেঁপের চার বীজতলা ও পলিথিন ব্যাগে তৈরী করা যায়। বীজতলায় চারা তৈরীর ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ সে.মি. সারি করে প্রতি সারিতে ৩ থেকে ৪ সে.মি. গভীরে বীজ বপন করতে হবে। পলিথিন ব্যাগে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১৫ী১০ সে.মি. আকারের পলিব্যাগে সমপরিমাণ পলি মাটি, বালি ও পচা গোবরের মিশ্রণ দ্বারা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভর্তি করতে হবে। পলিব্যাগের তলায় ২ থেকে ৩টি ছিদ্র করতে হবে এবং প্রতিটি ব্যাগে ২ থেকে ৩টি বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপনের পর ২ থেকে ৩ দিন অন্তর পানি দিতে হবে। বপনের ১৫ থেকে ২০ দিন পর চারা বের হয় এবং ৪০ থেকে ৫০ দিন পর তা রোপণের উপযোগী হয়।

বীজ ও চারার পরিমাণ: পেঁপের জন্য ২ী২ মি. দূরত্বে গর্ত তৈরী করে প্রতি গর্তে ৩টি করে চারা রোপণ করা হলে হেক্টর প্রতি ৭৫০০ চারা লাগবে এব শেষাবধি ২৫০০ গাছ থাকবে। এই সংখ্যক সুস্থ সবল চারা পেতে ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। তবে হাইব্রীড পেঁপের জন্য ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম বীজই যথেষ্ঠ।

গর্ত তৈরী: চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পূর্বে বেডের মাঝ বরাবর ২ মিটার দূরত্বে ৬০ ী ৬০ ী ৪৫ সে.মি. আকারে গর্ত তৈরী করতে হবে। গর্ত প্রতি ১৫ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ২০ গ্রাম বরিক এসিড এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মেশাতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি দ্বারা গর্ত পূরণ করে সেচ দিতে হবে।

বীজ বপন ও চারা রোপণের সময়: আশ্বিন এবং পৌষ মাস হল পেঁপের বীজ বপনের উত্তম সময় এবং বীজ বপনের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর অর্থাত মাঘ-ফাল্গুণ মাসে চারা রোপণের উপযোগী হয়।

চারারোপণ: চারা রোপণের আগে গর্তের মাটি ভালভাবে উলটপালট করে নিতে হবে। প্রতি গর্তে ৩০সে.মি. দূরত্বে ত্রিভূজ আকারে ৩টি করে চারা রোপণ করতে হবে। বীজ তলায় উৎপাদিত চারার উন্মুক্ত পাতা গুলি রোপণের আগে ফেলে দিলে রোপণ করা চারার মৃত্যু হার হ্রাস পায় এবং চারা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়। পলিব্যাগে উৎপাদিত চারার ক্ষেত্রে পলিব্যাগটি খুব সাবধানে অপসারণ করতে হবে, যাতে মাটির বলটি ভেঙ্গে না যায়। পড়ন্ত বিকেল চারা রোপণের জন্য উত্তম সময়। রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে চারার গোড়া বীজতলা বা পলিব্যাগে মাটির যতটা গভীরে ছিল তার চেয়ে গভীরে না যায়।

গাছে সার প্রয়োগ: ভাল ফলন পেতে হলে পেঁপেতে সময় মতো সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি গাছে ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের এক মাস পর হতে প্রতিমাসে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছে ফুল আসার পর এই মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে। মাটিতে রসের অভাব হলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

পরিচর্যা: পেঁপের জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। বর্ষা মৌসুমে আগাছা দমন করতে গিয়ে মাটি যাতে বেশি আলগা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

পানি সেচ ও নিকাশ: শুষ্ক মৌুমে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি সেচ দিতে হবে। সেচের ও বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে জন্য পানি নিকাশের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।

অতিরিক্ত গাছ অপসারণ: চারা লাগানোর ৩ থেকে ৪ মাস পর গাছে ফুল আসলে প্রতি গর্তে একটি করে সুস্থ্য সবল স্ত্রী গাছ রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলতে হবে। তবে সুষ্ঠু পরাগায়ণ ও ফল ধারণের জন্য বাগানের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে শতকরা ৫টি পুরুষ গাছ থাকা অপরিহার্য।

ফল পাতলা করণ: পেঁপের অধিকাংশ জাতের ক্ষেত্রে একটি পত্রক থেকে একাধিক ফুল আসে এবং ফল ধরে। ফল কিছুটা বড় হওয়ার পর প্রতি পত্রকক্ষে সবচেয়ে ভাল ফলটি রেখে বাকিগুলো ছিড়ে ফেলতে হবে। দ্বিতীয় বা তার পরবর্তী বছরে যে পেঁপে হয় সেগুলো ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে। ফলে ঠিকমত বাড়তে পারেনা এবং এদের আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ছোট ফলগুলো ছাঁটাই করতে হবে।

রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন: পেঁপের রোগবালাইয়ের মধ্যে ঢলেপড়া ও কাণ্ডপচা, এ্যানথ্রাকনোজ, মোজাইক ও পাতা কোঁকড়ানো রোগ অন্যতম। আর পোকার মধ্যে মিলিবাগ উল্লেখযোগ্য।

ঢলেপড়া ও কাণ্ডপচা রোগ: মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে বীজতলায় চারায় ঢলে পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়া বর্ষাকালে কাণ্ডপচা রোগ দেখা দিতে পারে। কাণ্ডপচা রোগ হলে গাছের গোড়ায় বাদামী বর্ণের পানি ভেজা দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত চারা গাছ মারা যায় এবং ঢলে পড়ে। প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা হিসেবে বীজতলার মাটি বীজ বোনার আগে শুকনা রাখতে হবে এবং সিকিউর নামক ছত্রাক নাশক ২ থেকে ৩ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করতে হবে। এ রোগের প্রতিকার হিসেবে রোগাক্রান্ত চারা গাছ উঠিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রিডোমিল এম জেড-৭২ ছত্রাকনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত কাণ্ডে ছিটিয়ে দিলে সুফল পাওয়া যায়।

এ্যানথ্রাকনোজ: এ রোগের কারণে ফলের গায়ে বাদামী পচন রোগ দেখা দেয়। ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।

প্রতিকার: ২ গ্রাম নোইন বা ব্যাভিস্টিন নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩বার ফলে গায়ে ¯েপ্র করতে হবে।

পেঁপের মোজাইক: এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। এ রোগ হলে পাতায় হলুদ রং এর ছোপ ছোপ দাগ পড়ে, পাতার বোঁটা বেঁকে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। জাব পোকার আক্রমণে এ রোগ ছড়ায়।

প্রতিকার: আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগ বিস্তারকারী পোকা দমনের মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

মিলিবাগ: সাম্প্রতিক সময়ে মিলিবাগ পেঁপের একটি তিকর পোকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আক্রান্ত পাতা ও ফলে সাদা পাউডারের মতো আবরণ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের পাতা ও ফল শুটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছ মারা যেতে পারে।

প্রতিকার: আক্রমণের প্রথম দিকে পোকাসহ আক্রান্ত পাতা বা কাণ্ড সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম সাবান পানি অথবা এডমায়ার ২০০ এসএল ০.২৫ মি.লি. হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার ¯েপ্র করতে হবে।

ফল সংগ্রহ: সবজি হিসেবে ব্যবহারের জন্য ফলের কষ যখন হালকা হয়ে আসে এবং জলীয়ভাব ধারণ করে তখন পেঁপে সংগ্রহ করতে হবে। অন্যদিকে ফলের গায়ে যখন হালকা হলুদ রং দেখা দেবে তখন ফল হিসেবে সংগ্রহ করতে হবে।

ফলন: উপযুক্ত যতœ নিলে পেঁপে চাষে হেক্টর প্রতি ৪০ থেকে ৬০ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়।

লেখক
মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
সেতাবগঞ্জ সুগারমিলস্ লিঃ
সেতাবগঞ্জ দিনাজপুর
মোবাইল: ০১৭২২৬৯৬৩৮৭

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৯মে২০