দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরাও আবাদকৃত শস্যের সময়োপযোগী ও উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে গবেষক ও বিজ্ঞানী, সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের ত্রিমুখী প্রয়াস দেশকে খাদ্যোৎপাদনে স্বয়ম্ভর করে তুলেছে। এখনো বাংলাদেশের জিডিপির সিংহভাগের জোগান দিচ্ছে কৃষি।
কৃষিতে এ অভূতপূর্ব সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কৃষকের কাছে সম্প্রসারণ সেবাকে আরো সহজলভ্য করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চালু হচ্ছে ইউনিয়ন কৃষি সেবাকেন্দ্র
গত চার দশকে দেশের কৃষিতে দেখা গেছে আমূল পরিবর্তন। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষিতে সাফল্য অর্জনের তাগিদ থেকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা এখন উপলব্ধি করছেন সবাই। সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদ থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক কৃষির দিকে ঝুঁকছেন দেশের কৃষকরা। বাড়ছে উৎপাদন। মিলছে খাদ্যনিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। আর এর কৃতিত্ব কৃষি বিভাগকেই দিচ্ছেন কৃষকরা। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতায় পৌঁছে দেয়ার জন্য কৃষি বিভাগের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো উপায়ও নেই।
দেশের মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় কৃষি বিভাগকে। সুযোগ-সুবিধা কম। উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি ও জাত কৃষকের কাছে সফলভাবে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধাও অনেক কম। এর পরেও বসে নেই কৃষি সম্প্রসারণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছেন কৃষকের কাছে।
দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরাও আবাদকৃত শস্যের সময়োপযোগী ও উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে গবেষক ও বিজ্ঞানী, সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের ত্রিমুখী প্রয়াস দেশকে খাদ্যোৎপাদনে স্বয়ম্ভর করে তুলেছে। এখনো বাংলাদেশের জিডিপির সিংহভাগের জোগান দিচ্ছে কৃষি।
কৃষিতে এ অভূতপূর্ব সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কৃষকের কাছে সম্প্রসারণ সেবাকে আরো সহজলভ্য করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চালু হচ্ছে ইউনিয়ন কৃষি সেবাকেন্দ্র। এর ফলে এখন থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকদের কৃষিসংক্রান্ত সেবা নিতে আর উপজেলা সদরে যেতে হবে না। নিজ নিজ ইউনিয়ন থেকেই কৃষি-সম্পর্কিত সব ধরনের সেবা পাবেন তারা। এসব কেন্দ্র মূলত ‘কৃষি সেবার ওয়ান স্টপ সেন্টার’ হিসেবে স্থাপন করা হচ্ছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে স্থাপিত কয়েকটি কৃষক সেবাকেন্দ্রের একটি চালু করা হয়েছে পাবনার চাটমোহর উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা এখন বেশ উচ্ছ্বসিত। তারা বলছেন, ওই এলাকার কৃষকদের মধ্যে সনাতন কৃষি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। এছাড়া শস্য আবাদ শুরুর আগ মুহূর্তে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ সেবা অথবা সার ও বীজ সংগ্রহ করতে গিয়ে এতদিন প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাদের। ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্রটি স্থাপন করার ফলে তাদের এ অসুবিধা দূর হলো। এছাড়া আধুনিক কৃষি উৎপাদন নিয়ে সেবাকেন্দ্রটি থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার মাধ্যমে নিজ উৎপাদনশীলতাও বাড়াতে পারবেন তারা।
এ ইউনিয়নের মহেলা গ্রামের কৃষক আ. মান্নান বলেন, সেবাকেন্দ্রটি চালু হওয়ার কারণে এখানকার কৃষকদের অনেক উপকার হয়েছে। ছোটখাটো কোনো অসুবিধার জন্য উপসহকারী কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিতে এখন আর উপজেলা সদরে যেতে হবে না। এজন্য কৃষকদের সময় ও অর্থ— দুটোই সাশ্রয় হবে।
পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নে স্থাপিত ত্রিতল সেবাকেন্দ্রটির নিচতলায় রয়েছে একটি হলরুম। যেখানে বসে কৃষকরা বিভিন্ন ফসল উৎপাদন নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারনে। উপরে রয়েছে এখানে নিযুক্ত উপসহকারী কর্মকর্তাদের জন্য তিনটি আবাসিক ভবন ও একটি স্টোররুম। ফসলে কোনো ধরনের পোকামাকড় বা রোগ-বালাইয়ের সংক্রমণ দেখা দিলে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা এখান থেকে নিতে পারবেন কৃষকরা। সময়মতো বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে সঠিক বয়সকালে চারা রোপণসংক্রান্ত পরামর্শও নিতে পারবেন এখান থেকে। কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবাও পাওয়া যাবে, নিয়মিতভাবে সন্ধ্যায় এখানে এসে প্রয়োজনীয় সেবা ও পরামর্শ নিতে পারবেন কৃষকরা।
কৃষি সেবাকেন্দ্রটি স্থাপনের পেছনে বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাসান রশিদ হোসাইনী বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়ন, চাহিদাভিত্তিক ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, কৃষিবিষয়ক পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দান, কৃষক সমাবেশ আয়োজন, কৃষি মিউজিয়াম, ফসলের রোগ ও পোকা নিরাময়, মাটি পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ, আপত্কালীন চারা উৎপাদন পদ্ধতি এবং কৃষি উপকরণ বিতরণের জন্য স্থাপিত কৃষি সেবাকেন্দ্রটি স্থানীয় কৃষিতে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে।
তবে সার্বিক বিষয় নিয়ে কৃষকদের পক্ষ থেকেও কিছু পরামর্শ ও দাবি রয়েছে। পার্শ্বডাঙ্গার অধীন অর্জুন গ্রামের কৃষক মো. ময়েন উদ্দিন বলেন, সব জিনিসেরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। সেবাকেন্দ্রটি স্থাপনের ফলে নিঃসন্দেহে কৃষকদের উপকার হবে। তবে আমাদের দেশের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মূলত ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। অনেক জটিল বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে কোনো সমাধান পাওয়া না গেলে এ নিয়ে কৃষকদের আরো ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কাছে ছুটতে হয়। সে কারণে পাক্ষিক বা মাসিক ভিত্তিতে জেলা পর্যায়ের কোনো এক কৃষি কর্মকর্তা এ কেন্দ্র পরিদর্শন করলে ও আমাদের পরামর্শ দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নটি চলনবিল অধ্যুষিত এলাকা। রাস্তাঘাটের তেমন ভালো অবস্থা না থাকার কারণে যোগাযোগও বেশ কষ্টসাধ্য। অতীতে দেখেছি, প্রযুক্তিগত বিষয় জানতে এবং ফসলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অবগত হওয়ার জন্য এ এলাকার কৃষকরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হলেও প্রয়োজনীয় যানবাহনের অভাবে তারা সময়মতো আসতে পারেন না। মোবাইল ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তব অবস্থা বোঝানো বেশ কঠিন। এসব কর্মকর্তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মাঠপর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ ও সেবা দেয়ায় কোনো কার্পণ্য না থাকার সুফল এখন ভালোভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কৃষকবান্ধব অবকাঠামো, যানবাহনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা স্থাপন করা গেলে উৎপাদন আরো বাড়ানো যেত।
এ বিষয়ে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আজাহার আলী বলেন, সম্প্রসারণ বিভাগে জেলা পর্যায়ে কৃষি প্রশিক্ষণ অফিসার ও অতিরিক্ত উপপরিচালক হিসেবে চারজন কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। পাবনায় শুধু উপপরিচালকের একটি বাহন রয়েছে। সেটিও বেশ পুরনো। প্রায় সময়ই তা অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। ফলে মাঠ পরিদর্শন ও কৃষকদের জরুরি পরামর্শ প্রদান করা দুরূহ হয়ে পড়ে। দুর্গম উপজেলাগুলোয় কোনো ধরনের জটিল সমস্যা দেখা দিলে সংশ্লিষ্টদের সেখানে পৌঁছতে বেশ দেরি হয়ে যায়। তখন কৃষকদের প্রকৃত সেবা দেয়ায় বেশ অসুবিধা দেখা দেয়। তার পরও কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে তাদের কাছে গিয়ে যথাযথ পরামর্শ দিয়ে সমস্যার যথাসাধ্য সমাধান করা হয়ে থাকে। বি বি
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪.কম/মোমিন