বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের শস্যের আবাদ থেকে কৃষক কেমন মুনাফা পাচ্ছেন তা জানতে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে ইউএসএআইডি। এজন্য দেশের আটটি জেলার প্রায় ৪০০ জন কৃষকের ওপর জরিপ চালিয়েছে সংস্থাটি। তাদের কাছ থেকে ১৯টি শস্যের বিষয়ে তথ্য নেয়া হয়েছে। ‘স্ট্যাডি অন প্যাটার্ন অব ফিন্যান্সিয়াল ফ্লো উইথইন এগ্রিকালচারাল মার্কেট সিস্টেম’ শীর্ষক এ গবেষণায় দেখা গেছে, শস্য আবাদে কৃষককে মুনাফা দেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে টমেটো। এর পরই রয়েছে গ্রীষ্মকালীন সবজি, মসুরের ডাল ও শীতকালীন সবজি। তবে সবচেয়ে কম মুনাফা দিচ্ছে আলু, গম, বাদাম ও ধান।
গবেষণার তথ্যমতে, টমেটো চাষে কৃষকের বাড়তি আয় হয় মোট ব্যয়ের ২৬৬ শতাংশ বেশি। অন্যান্য শস্যের মধ্যে গ্রীষ্মকালীন সবজিতে ২৪৯, মসুর ডালে ১৯২, শীতকালীন সবজিতে ১৮৮, ভুট্টায় ১০৯, হলুদ, কাঁচামরিচ ও রসুনে ৬৯, তেলবীজ জাতীয় শস্যে ৮৮, বাদামে ৫৩, ধানে ৬১, গমে ৩৪ ও আলুতে মাত্র ৩২ শতাংশ বাড়তি আয় করছেন কৃষক। এছাড়া ফুল চাষে ১৩৭ শতাংশ, পাটে ১১৬, আমে ১৪৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ফলে গড়ে ৭৫ শতাংশ বাড়তি আয় হচ্ছে কৃষকের।
তবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শস্যের দামের সমন্বয় করলে কৃষকের মুনাফার পরিমাণ আরো কম হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, কৃষক যদি সঠিক দাম না পান কিংবা ভর্তুকির অর্থের সুবিধা দিয়ে উৎপাদন খরচ কমাতে না পারেন, তাহলে শস্য আবাদে নিরুৎসাহিত হবেন। ফলে কৃষি থেকে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায় কৃষকের। এমনটি হলে এর প্রভাব পড়বে সার্বিক উৎপাদনে, যা খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দেবে দেশকে। তাই কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে এখনই নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের অর্থ সহায়তার সিংহভাগই বাজার ব্যবস্থাপনা, মজুদাগার শিল্প, প্রক্রিয়াজাত শিল্পে ব্যবহার বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি অগ্রাধিকার দিতে হবে প্রান্তিক ও সাধারণ কৃষকের উন্নয়নে।
কৃষককে বাড়তি আয় এনে দিতে টমেটো কিংবা গ্রীষ্মকালীন সবজির ভূমিকা বেশি থাকলেও এসবের আবাদ খুব বেশি বাড়ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৬ হাজার একর জমিতে টমেটো আবাদ হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৭
হাজার এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৮ হাজার একর জমি শস্যটির আবাদ হয়েছে। গত তিন বছর ধরেই গড়ে টমেটোর একরপ্রতি উৎপাদন ৫ হাজার ৫০০ কেজি থেকে ৫ হাজার ৭০০ কেজির মধ্যেই ওঠানামা করছে।
অন্যদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৩ হাজার একর জমিতে গ্রীষ্মকালীন সব ধরনের সবজির আবাদ হয়। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৬ হাজার একর ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮৭ হাজার একর জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজির আবাদ হয়। গত কয়েক বছর ধরেই একরপ্রতি গ্রীষ্মকালীন সবজির গড় ফলন ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ কেজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। মসুরের আবাদও কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার একর জমিতে আবাদ হলেও পরের অর্থবছরে প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার একর এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার ২২৪ একর।
অন্যদিকে কম মুনাফার শস্যগুলোই আবাদে শীর্ষে রয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ১২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে প্রায় ৮৩ লাখ আলু উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া ১০ লাখ ২৬ হাজার একর জমিতে ১২ লাখ ৭৮ হাজার টন গমের উৎপাদন হয়েছে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ কোটি ৭১ লাখ ৮৪ হাজার একর জমিতে প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ টন ধান, ১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৩৩ একর জমিতে ৪ লাখ ২৫ হাজার টন রসুন এবং ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪৬১ একর জমিতে ১ লাখ ৩৭ হাজার টন কাঁচামরিচের উৎপাদন হয়েছে।
এ অবস্থায় কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনে শস্য উৎপাদন বাড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের দেয়া বিভিন্ন ধরনের উপকরণ সহায়তার পাশাপাশি ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। সুবিধাভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বের হয়ে নিয়মতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। কৃষকের মুনাফা বৃদ্ধি শুধু নয়, শস্যের ভারসাম্যপূর্ণ আবাদের মাধ্যমে জমির উর্বরাশক্তি ধরে রাখা ও পরিবেশের ভারসাম্য আনতে শস্য বহুমুখিতায় জোর দেয়া হয়েছে। সার্বিক কার্যক্রমের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন