জাহিদ রিপন, পটুয়াখালী থেকে : লবণাক্ত উপকূলীয় এলাকার উপযোগী প্রতিকূলতা সহিষ্ণু শস্যবীজ উৎপাদন করে কৃষকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পটুয়াখালী জেলার সাগর তীরবর্তী দশমিনা উপজেলায় গড়ে তোলা হয় দেশের সর্ববৃহৎ বীজ বর্ধন খামার। শষ্য ভাণ্ডর খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে শুরু থেকেই কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।
উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন জেলার দশমিনার বাঁশবাড়িয়ার একত্রে সংযুক্ত তিনটি চর-চরবাঁশবাড়িয়া, চরবোথাম ও চরহায়দার নিয়ে বীজ বর্ধন খামারটি প্রতিষ্ঠা করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।
কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আর্থিক সহায়তা ১ হাজার ৪৪ একর জমির উপর প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৪ সালের জুন মাসে প্রথম মেয়াদ শেষে ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রকল্পটির দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়। এরপরে একনেকের সিদ্ধান্তে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। খামারটিতে রয়েছে একটি অফিস ভবন, ৫শ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বীজ গুদাম, একটি কাভার্ড থ্রেসিং ফ্লোর, তিনটি সানিং ফ্লোর, একটি ওয়ার্কসপসহ বায়োগ্যাস প্লান্ট, ক্যাটেল সেড ও ইমপ্লিমেন্ট সেড। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে বরিশালে একটি কোল্ড স্টোরেজ ও একটি প্রসেসিং সেন্টার।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে মৌল বীজ এনে ভিত্তি বীজ উৎপাদনের কাজ শুরু করে দশমিনা বীজ বর্ধন খামার। খরা সহিষ্ণু, জলমগ্নতা সহিষ্ণু, লবণসহিষ্ণু ফসল উৎপাদনে কৃষকের আস্থাও অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ও উচ্চফলণশীল ব্রি-৫২ ধান, স্থানীয় আবহাওয়ায় সহনশীল আফ্রিকান নেরিকা-১, নেরিকা-১০ ও নিউট্যান্ট প্রজাতির ধান বীজের আবাদও করা হয়। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে সমন্বয় রেখে বরিশালের বিখ্যাত বালাম ধানসহ বিলুপ্ত প্রায় স্থানীয় প্রজাতির ধান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে খামার কর্তৃপক্ষ।
এছাড়াও বোরো ধান, সূর্যমুখী, সয়াবিনসহ বিভিন্ন তৈল বীজ, ডাল, সরগম ও ববি শষ্যের বীজ উৎপাদিত হয়।
এখানকার উৎপাদিত বীজ লাকুটিয়া প্রসেসিং সেন্টারে প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেজিং করে বিপনন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। বীজ বিপনন অধিদপ্তর বিএডিসির ডিলারদের মাধ্যমে তা চাষিদের কাছে সরবরাহ করে থাকে। এ কাজের জন্য বিএডিসির পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় স্থানীয় চাষীরা এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায়। এতে তারা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি চাষের আধুনিক পদ্ধতি শিখে তাদের নিজস্ব জমিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে বাড়তি লাভ তুলে নিতে সক্ষম হয়। বোরো মৌসুমে এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে স্থানীয় নারীরাও।
বিষমুক্ত কৃষিপণ্য উৎপাদনসহ খামারের কাজের সুবিধার্থে এবং বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড ও চায়না বোসিমা কোম্পানির কারিগরি সহযোগিতায় খামারের ভিতরেই ৪০ হাজার ৮০৪ বর্গফুট জমির উপর দেশের বৃহত্তম বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। খামারের বিভিন্ন ফসলের বর্জ্য ও আবর্জনা এ প্লান্টে ব্যবহার করে ২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত হয় এ প্লান্ট। সাধারণত বায়োগ্যাস প্লান্ট বিষ্ঠা দিয়ে গ্যাস উৎপাদন করে। কিন্তু দশমিনা বীজ বর্ধন খামারের বায়োগ্যাস প্লান্ট খড়কুঠা, ঘাস-লতা-পাতা ব্যবহার করে গ্যাস উৎপাদন করে। গ্যাস উৎপাদনের পর উদ্বৃত্ত পদার্থ দিয়ে উন্নত মানের জৈব সার উৎপন্ন করে খামারের কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ৫০০ ঘনমিটার বায়োগ্যাস, ৮০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ও দেড় টন উন্নতমানের জৈব সার উৎপাদিত হত।
কিন্তু তেতুলিয়া নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে খামারের উত্তর এবং পাশ্চিমাংশের প্রায় ৬০ একর জমি। জোয়ারের পানি ঢুকে ক্রমাগত প্লাবিত হচ্ছে প্রকল্প এলাকা। ব্যহত হচ্ছে শ্রমিকদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। বিনষ্ট হচ্ছে রবিশস্যসহ অনেক ফসল। কিন্তু ভাঙন প্রতিরোধে প্রতিবছর মেনটেনেন্স ড্রেজিং করা হলেও তা থেকেও কোন সুফল আসছে না।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন