বাণিজ্যিকভাবে ভেড়া পালন করতে যে বিষয় জানা জরুরি

3016

ভেড়া-পালন

গবাদি পশুর মধ্য ভেড়া দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। আপনারা যারা দ্রুত লাভবান হতে চান তারা ভেড়া পালন করতে পারেন। কেননা ছাগলের মতো ভেড়াও দ্রুত বাচ্চা দিয়ে থাকে। আর ভেড়ার তুলনামূলকভাবে অসুখ বিসুখও কম হয়। অন্যান্য পশুর মধ্য ভেড়ার মাংসে ভিটামিনও বেশি। তাই যারা বাণিজ্যিকভাবে ভেড়া পালন করতে চান তারা অবশ্যই সবকিছু জেনে বুঝে এ প্রকল্পে হাত দিবেন। তা না হলে লাভের বদলে লোকসান গুনতে হবে। আপনাদের জন্য ভেড়া পালন বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

ভেড়ার জন্য কেমন বাসস্থান:

আমাদের দেশে যেসব কারণে ভেড়ার মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে অন্যতম হলো অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান। ভেড়ার রাখার জন্য অধিকাংশই কৃষকেরই ভালো ঘর নেই। তাছাড়া ২০/৩০ টি’র বেশি ভেড়া আছে এমন খামারীদের ভেড়ার জন্য স্বাস্থসম্মত বাসস্থান নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারিবারিকভাবে পালিত ভেড়া রাখা হয় কৃষকের ঘরের মাচা বা চৌকির নীচে বা ঘরের পাশে ছোট্ট একটি চালা বেঁধে তার মধ্যে যেখানে আলো বাতাস প্রবেশের সুযোগ কম। কিন্তু সামান্য খরচ করেই ভেড়া রাখার জন্য একটি স্বাস্থসম্মত বাসস্থান তৈরি করা যায়। ছাগল বা ভেড়া বাসস্থান তৈরির সময় একটি বিষয় খেয়াল রাখা খুব জরুরি আর তাহলো মেঝে কাঁচা বা পাকা যেমনই হোক সেখানে ভেড়া না রেখে মাচা বা স্লাট এর উপর ভেড়া পালন করা।

ভেড়ার খাদ্য:

ভেড়া এমন একটা প্রাণী যা সবকিছু খায়। তাই ভেড়া পালনে খাদ্য খরচ কম। ভেড়া একটি তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণি। ভেড়া সাধারণত: চরে খেতে পছন্দ করে। ভেড়ার অন্যান্য রোমন্থক প্রাণির মতো চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পরিপাকতন্ত্র এবং ভেড়া আশঁ জাতীয় খাদ্য, লতা-পাতা প্রভৃতিকে সহজেই সাধারণ শর্করাতে পরিণত করতে পারে।

এছাড়া ভেড়া স্বাভাবিক এবং প্রতিকুল উভয় অবস্থাতে’ই শুকনা খড় এবং খড় জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। আমাদের দেশে ভেড়ার চরে খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য নেই। তাছাড়া বর্তমান সময়েও আবদ্ধ পদ্ধতিতে ভেড়া পালন একটি বিরল ঘটনা। গরু, ছাগল এবং পোল্ট্রি আবদ্ধ পদ্ধতিতেও পালন করা হয় এবং এ জন্য তাদের দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা হয়। যেহেতু চরে খেয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রাপ্তি ঘটে না তাই বয়স ভেদে নিম্নোক্ত মিশ্রনের দানাদার প্রতিদিন ২০০-৩০০ গ্রাম হারে খাওয়ানো যেতে পারে।

দানাদার খাবারের মধ্যে প্রধান হল- গমের ও ছোলার ভুষি, সয়াবিন খৈল, ভুট্টা ভাঙা, খনিজ ও ভিটামিন প্রিমিক্স ইত্যাদি।

ভেড়ার রোগ-বালাই:

ভেড়ার রোগ-বালাই তেমন হয় না। তবে এন্টরোটক্সিমিয়া, আমাশায়, ধনুষ্টংকার, ক্ষুরা, একথাইমা, পিপিআর, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগ হতে পারে। ভেড়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যকরণীয় বিষয় হলো নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা। গোলকৃমি, ফিতাকৃমি, কলিজাকৃমি ভেড়াকে আক্রান্ত করে। প্রতি ২/৩ মাস পরপর ভেড়াকে কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

আমাদের দেশে ভেড়াকে নিয়মিত শেয়ারিং করা বা পশম কাটা হয় না। তাই শরীরে বড় পশমের কারণে বিভিন্ন ধরনের বহিঃ পরজীবী বাস করে এবং বড় পশমের কারনে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ হয়। এজন্য বছরে অন্ততঃ দু’বার ভেড়ার পশম কাটতে হবে এবং গোসল করাতে হবে তাহলে উকুন, আঠালি, টিক ইত্যাদির প্রকোপ কম হবে। নিয়মিত পিপিআর টিকা প্রদান করতে হবে। এছাড়া ভেড়ার বাচ্চাকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।

পানি পান:
ভেড়ার পানি গ্রহণের পরিমাণ কিছু কারণে কম বেশি হয়। ভেড়া কি পারিমাণ পানি পান করবে তা ঋতু, গৃহিত খাদ্যের গুণাগুন ও ধরনের ওপর নির্ভর করে। যদি কাঁচা ঘাস খায় তাহলে পানি কম খাবে। যদি আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা হয় এবং দানাদার ও শুকনা খাদ্য খায় তাহলে বেশি পরিমান পানি পান করবে। আমাদের ছাগল, ভেড়া এবং দেশি মুরগিকে পরিষ্কার, বিশুদ্ধ পানি খাওয়ানোর প্রবনতা খুব কম। এরা নিজেরা অনুসন্ধান করে যেখানে পায় পানি খেয়ে পিপাসা নিরারণ করে। এ কারনে রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হয়। তাই ভেড়াকে পরিষ্কার বিশুদ্ধ পান সরবরাহ করতে হবে।

ভেড়ার প্রজনন:
অন্য দলবদ্ধ প্রাণির মতোই ভেড়ার প্রজনন। যদিও কিছু কিছু ভেড়া সারা বছর ধরে প্রজনন হয়। ভেড়ি সাধারণত: ৬-৮ মাসে প্রজনন উপযোগী হয় এবং পুরুষ ভেড়া ৪-৬ সপ্তাহ বয়সে যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। তবে জাত ভেদে এই বয়সের ভিন্নতা হতে পারে।

যেমন- ফিনশিপ জাতের ভেড়ি ৩-৪ মাস বয়সে এবং মেরিনো ভেড়ি কোন কোন সময় ১৮-২০ মাস বয়সে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। ভেড়ার ঋতুচক্র ১৭ দিন পর পর আর্বতিত হয়। গর্ভকাল ৫ মাস। ১০-১২ টি ভেড়ির জন্য একটি প্রজননক্ষম পাঠাই যথেষ্ট।
ভেড়ি উপযুক্ত দৈহিক ওজনপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পাল দেয়া ঠিক নয়। কম ওজনের ভেড়ি থেকে প্রাপ্ত বাচ্চার মৃত্যুহার বেশি হয় এবং মা ভেড়ি হতে পরবর্তীতে ভালো সার্ভিস পাওয়া যায় না। একটি পাঠাকে ১০০-২০০ বারের বেশি প্রজনন করানো ঠিক নয়। এছাড়া প্রজনন কাজে ব্যবহৃত পাঠার বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে অঙ্কুরিত ছোলা এবং দৈনিক ৩৫০- ৫০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।

এছাড়া যে ভেড়ি উপযুক্ত সময়েও ডাকে আসে না সে ভেড়িকে এবং পাঠাকে এডি৩ই ইনজেকশন প্রদান করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া অন্তঃপ্রজনন (inbreeding) এড়াতে সময়ে সময়ে নিজের পালের পাঠা বাদ দিয়ে অন্য পাল থেকে পাঠা আনতে হবে।

ভেড়ার বাচ্চার যত্ন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা:

আমাদের দেশে ভেড়ার পরিকল্পিত বাণিজ্যিক খামার খুব একটা নেই বললেই চলে। একেবারে পারিবারিক পর্যায়ে ভেড়া পালন করা হয়। মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে এভাবে ভেড়া পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভেড়ার বাচ্চার অধিক মৃত্যুহার। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রসবকালীন অব্যবস্থাপনা ও পুষ্টিহীনতা প্রধান।

তাছাড়া বাচ্চা প্রসবের পর পর মা ভেড়ির সাথে বাচ্চাকেও মাঠে নিয়ে যাওয়া। সারাদিন মা ভেড়ির সাথে মাঠে মাঠে ঘুরার কারনে শারিরীকভাবে দুর্বল বাচ্চাতে প্রচন্ড ধকল পড়ে এবং মারা যায়। তাই বাচ্চা প্রসবের পর ধকল সহ্য করার সামর্থ্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মা ভেড়ির থেকে কিছুদিন আলাদা করে রাখতে হবে। বাচ্চাকে শাল দুধ খাওয়াতে হবে এবং যেহেতু মা ভেড়ি থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ দুধ পাওয়া যায় না সেজন্য দুধের বিকল্প খাওয়াতে হবে। টেবিলে উল্লেখিত খাদ্য প্রদান করা যেতে পারে।

সাধারনতঃ আমাদের দেশে ভেড়া একসাথে গড়ে ২টি করে বাচ্চা দেয় এবং বাচ্চার গড় ওজন ১-১.৫ কেজির মতো হয়। জন্মের পর প্রতিটি বাচ্চার জন্য দৈনিক ৩০০ গ্রাম শাল দুধ প্রয়োজন হয় এবং ৪ সপ্তাহ বয়সে ৫০০ মিলি দুধ দিতে হয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থায় দেখা গেছে যে এদেশের ভেড়া হতে ওই পরিমাণ দুধ পাওয়া যায় না। ফলে পুষ্টিহীনতায় জন্ম নেয়া বাচ্চা জন্মের পরেও পুষ্টিহীনতায় ভুগে। ভেড়ার বাচ্চার মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এটা। এ কারণে মায়ের দুধের বিকল্প দুধ অথবা গরুর দুধ ফিডার বা নিপলে করে খাওয়াতে হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে ভেড়ার বাচ্চার মৃত্যুহার কমে যাবে।

কেন ভেড়া পালন করবেন?

১. ভেড়া ছোট নিরীহ প্রাণি। এদের খাদ্য খরচ কম, রাখার জন্য অল্প জায়গা দরকার হয় এবং প্রাথমিক বিনিয়োগ কম বলে শুধুমাত্র বসতঃ বাড়ি আছে এমন কৃষক আনায়সে ৫-১০ ভেড়া পালন করতে পারেন। যে কোন প্রাণি প্রতিপালনের চেয়ে ভেড়া পালনে উৎপাদন খরচ কম।

২. ভেড়া সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পছন্দ করে তাই কেউ যদি বাণিজ্যিকভিত্তিতে ভেড়া পালন করতে চায় সেক্ষেত্রে একজন লোক সহজেই ১০০-১৫০ ভেড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

৩. ভেড়ার অভিযোজন ক্ষমতা ছাগলের চেয়ে বেশি তাই যেকোন প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ায়ে চলতে পারে। ভেড়া গরুর পালের সাথে একসাথে পালন করা যায়।

৪. ভেড়া অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য গ্রহণ করে তা উচ্চমূল্যের প্রোটিনে পরিণত করে বলে ভূমিহীন কৃষক, প্রান্তিক চাষি এবং নারী ও কর্মহীন মানুষদের সংসারে বাড়তি আয়ের একটা ভালো যোগান হতে পারে ভেড়া পালন।
৫. ভেড়ার মাংস তুলনামূলকভাবে নরম, রসালো ও গন্ধহীন এবং মাংসের আঁশ চিকন বলে সহজপাচ্য।
৬. ভেড়া প্রধাণত: বছরে ২ বার বাচ্চা প্রদান করে এবং প্রতি প্রসবে নিম্নতম ২টি বাচ্চা দেয় এ কারণে কম সময়ে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি হয়।
৭. ভেড়ার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
৮. ভেড়া পালন করে থেকে শুধু মাংসই পাওয়া যায় না, ভেড়া থেকে পাওয়া যায় উন্নতমানের গরম কাপড় তৈরির জন্য পশম এবং চামড়া।

একটা গরু পালনের জন্য যে পরিমান জায়গার দরকার হয় সে পরিমাণ জায়গায় ৬টি ভেড়া পালন করা যায়। অন্যান্য প্রাণি যে সমস্ত ঘাস স্পর্শই করে না এমন ঘাস ভেড়া খায় এমনকি ক্ষতিকর ও বিষাক্ত ঘাসও ভেড়া খায় এবং ভেড়া হতে খুব কম সময়ে অনেক বাচ্চা পাওয়া যায়। ভেড়া পালনে উৎপাদন খরচ অন্যান্য প্রাণি পালনের চেয়ে কম হওয়ায় সমান বিনিয়োগে একজন উৎপাদনকারী বা পালনকারী বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারেনে। তবে পারিবারিক খামারে ভেড়া পালন বেশি লাভজনক।

এখন অনেক উন্নতমানের দ্রুত উৎপাদনশীল ভেড়ার জাত আছে। খামারিকে তার সক্ষমতা ও পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে জাত বাছাই করতে হবে।

তথ্যসূত্র : ১. ভেড়া পালন পুস্তিকা, সমাজভিত্তিক ও বাণিজ্যিক খামারে দেশি ভেড়ার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রকল্প ও নেট থেকে সংগৃহিত।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন