গরুর জাত নিয়ে এখন বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। শঙ্করায়নের মাধ্যমে দেশে এখন বিভিন্ন প্রজাতির গরুর সম্পসারণ ঘটনো হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হচ্ছে ডেইরি ক্ষেত্রেও। তাই আপনি যদি খামার করতে চান তাহলে প্রথমে আপনাকে চিনতে হবে গরুর জাত সম্পর্কে। আপনি কোন জাতের গরু পালন করতে চান সেটা আগে নির্ধারণ করুন। সেই জাত সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে খামার করার সিদ্ধান্ত নেন।
গরুর নাম :
লাল সিন্ধী যেটাকে আমরা সিন্ধি বলেই জানি, জেবু (বস ইন্ডিকাস) জাতের সবচে জনপ্রিয় এই জাতটি আমাদের আজকের আলোচিত গরু। যেহেতু থারপারকার জাতের গরুকে সাদা সিন্ধী বলা হয় তাই থারপারকার থেকে আলাদা করার জন্য সিন্ধি গরুকে লাল সিন্ধি বলা হয়। লাল সিন্ধি ছাড়াও এই গরুকে মালির এবং লাল করাচি নামেও ডাকা হয়।
ওজন : ষাঁড় : ৫০০-৭০০ কেজি
গাভী : ৩০০-৪০০ কেজি
বাছুর : ২২ – ৩০ কেজি
উৎস দেশ :
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে জন্ম নেয়া লাল সিন্ধি পরবর্তীতে এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকা মহাদেশের কম করে হলেও ৩৩ টা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত নরম ইউরোপিয়ান (বস টোরাস) জাতের গরুকে গরম প্রতিরোধী এবং রোগ প্রতিরোধী করার জন্য ক্রস এর উদ্দেশ্যে প্রধানত বর্তমান সময়ে এই গরু ব্যবহার করা হয় যদিও এক সময় এটাই ছিল উপমহাদেশের প্রধান দুধ এবং মাংস উৎপাদনকারী গরু।
পৃথিবীর প্রায় ৩৩ টা দেশে লাল সিন্ধি জাত পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়। ১৯৫৪ সালে অস্ট্রেলিয়া প্রথম লাল সিন্ধী লোকাল ফ্রিজিয়ান গরুর সাথে ক্রস করার জন্য পাকিস্তান থেকে আমদানি করে। অস্টেলিয়া ছাড়াও ব্রাজিলে রয়েছে এই গরুর ক্রস জাতের আধিক্য।
পালনকারী দেশ :
লাল সিন্ধি পাকিস্তানের জাত হলেও ভালো ইন্ডিজেনাস জাত হওয়ায় পৃথিবীর ৩৩ এর অধিক দেশে এটা পালন করা হয়। কোথাও লোকাল জাতের সাথে ক্রস ব্রীড হিসাবে অথবা কোথাও মাংস উৎপাদনকারী এবং কোথাও মাংস ও দুধ উভয় উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। তবে এই জাতের প্রধান পালনকরী দেশ পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রাজিল।
বৈশিষ্ট ও সুবিধা :
সিন্ধি গরু দেখতে শাহিওয়াল এর চেয়ে গারো লাল রংয়ের অথবা কালচে লাল রংয়ের হয়ে থাকে। গলায়, ঘাড়ের উপরে অথবা কপালে কালচে রংয়ের ছটা দেখা যায়। মোটা তীক্ষ সিং এবং অভিজাত চেহারা সিন্ধি গরুকে অন্য সকল জাত থেকে সহজেই আলাদা করে রেখেছে। প্রচন্ড গরম ও বৈরী অঞ্চলের জাত হওয়ায় সিন্ধি গরু সহজেই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারে এবং সাথে রয়েছে রোগ প্রতিরোধের সহজাত ক্ষমতা। যে কারণে আমাদের দেশে খুব সহজে এই জাতের গরু পালন করা যায়।
দুধ ও মাংস উৎপাদন :
সিন্ধি গরু এক ল্যাক্টেশন পিরিয়ডে গড়ে ২০০০- ৩০০০ কেজি উত্তম মানের দুধ প্রদান করে। এই জাতের গরুর দুধে গড়ে ৪.৫-৫ % ফ্যাট থাকে। দুধের অন্যান্য উপাদানও ফ্রিজিয়ান গরু থেকে বেশি থাকে। সিন্ধি জাতের ষাঁড়ের ওজন বেশি হওয়ায় এবং মাংসের স্বাদ ও গুন্ ভালো হওয়ায়, এই জাতের ষাঁড় ভালো দামে বিক্রি হয়। আমাদের দেশের হাটে প্রচুর এই জাতের গরু দেখা যায়। আমাদের দেশে পাবনা অঞ্চল এই জাতের প্রধান পালনকারী এলাকা যদিও ইউরোপিয়ান জাতের ভিড়ে সিন্ধি গরুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব :
উভয় পারপাস গরু হিসাবে ভালো মানের মধ্যম পরিমান দুধ এবং উন্নত মানের বড় আকৃতির ষাঁড় এই গরুকে অর্থনীতিতে শক্ত অবস্থানে দাড় করিয়েছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকে যে ২ টা জাতের গরুর উপর নির্ভর করে পাবনার চলন বিল কেন্দ্রিক দুগ্ধ অর্থনীতি শুরু হয়, তার একটা এই সিন্ধি জাতের গরু। শাহিওয়াল এবং সিন্ধি গরুর দুধের উপর ভিত্তি করেই ১৯৪৬ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘মিল্ক ভিটা’। এখনো শুধু পাকিস্তান বা ইন্ডিয়া নয়, আমাদের দেশেও গরু কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে এই জাতের গরু একটা বড় অংশ দখল করে আছে। রোগ প্রতিরোধী হওয়ায় এই জাতের গরুর চিকিৎসা ব্যয় কম এবং দুধের মান ভালো হওয়ায় দুধ অধিক মূল্যে বিক্রয় হয়।
‘সিন্ধী’ গরু পালনে সমস্যা :
সিন্ধী আমাদের দেশের এক সময়ের প্রধান দুধ ও মাংস উৎপাদনকারী গরু হলেও বর্তমান সময়ে গোখাদ্যের অতি মূল্যের কারণে এবং ইউরোপিয়ান অধিক দুধ উৎপাদনক্ষম গরুর ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। দুধ উৎপাদনকাল ছোট হওয়ায় দুধ উৎপাদনের জন্য সিন্ধী গরু এখন আর সব সময়, সব অঞ্চলে লাভজনক প্রমাণিত হয়না, যদিও দুগ্ধজাত পণ্য এবং মাংস উৎপাদনের জন্য এখনো এই জাতের গরু পালন করা হয়। পাকিস্তানে সরকারি ভর্তুকি দিয়ে এই জাতের গরু পালনে উৎসাহী করা হচ্ছে।
জীবনকাল :
দীর্ঘ জীবনকালের অধিকারী সিন্ধী জাতের গরুর গড় দুধ উৎপাদনকাল ২০ বছর। এই জাতের গরুর গড়ে প্রায় ২৪-২৭ বছর বেঁচে থাকে।
তথ্যসূত্র : ১. ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি, এপার্টমেন্ট অফ এনিম্যাল সাইন্স। ২. পাকিস্তান ভেটেনারি জার্নাল, ইউনিভার্সিটি অফ ফয়সালাবাদ। ৩. সেন্ট্রাল কোস্টাল এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়া। ৪. উইকিপেডিয়া।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন