মো. রুবেল ইসলাম-তাহমিদ, মুন্সীগঞ্জ থেকে: মুন্সীগঞ্জ আবহমান গ্রাম বাংলার চিরচেনা চিত্র হলো সবুজ বন-বনানী। বাড়ির পেছনের অংশে বাঁশ ঝাড়, গাব গাছসহ অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছের মধ্যে একটি ছিল বেত গাছ। কাঁটাযুক্ত বেত গাছ লতার মতো হলেও এটি নরম প্রকৃতির নয়। এর ফলকে বেত ফল বা বেথুন বলে। আঙুরের মতো থোকা থোকা ফল চৈত্র-বৈশাখ মাসে পেকে থাকে। দুষ্ট ছেলেমেয়ের দল অনেক কষ্ট শিকার করে বেত ফল সংগ্রহ করে লবণ মরিচ দিয়ে ভর্তা বানিয়ে তা খুব মজা করে খেত। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের বেত ফল কী তা খুঁজতে গাছের বিশ্বকোষ চষে বেড়াতে হয়।
গ্রামের কৃষক শ্রেণির অতি প্রয়োজনীয় গাছ হিসেবে পরিচিত বেত গাছ। তারা বেত দিয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকে। কৃষকের মাটি কাটার ওড়া, বিশেষ কাজে ব্যবহারের জন্য ঝাঁকা বা ধামা বা টুকরি তৈরি, নারীদের তৈরি শীতল পাটি, নামাজের পাটি, ভাত খাওয়ার পাটি, হাত পাখা, হাতের লাঠি তৈরি ইত্যাদি কাজে বেত ব্যবহার হয়ে থাকে। আর শহরের অভিজাত শ্রেণির জন্য চেয়ার, সোফা, দোলনা, ফুলদানি তৈরিসহ নানা কাজে বেতের অনেক কদর।
বেত একটি মূল্যবান, টেকসই এবং স্মার্ট শ্রেণির দ্রব্য হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু কালের আবর্তে মানুষ তার প্রয়োজনে ঝোপ-ঝাড়ের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে। সাবাড় করে দিয়েছে বাড়ির আশপাশের ক্ষুদ্র প্রকৃতির বন। তাই গ্রাম থেকে আজ মুন্সীগঞ্জ সদর টংগিবাড়ি লৌহজং সিরাজদিখান, শ্রীনগর এ উপজেলাগুলো থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান বেত। যাকে গ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় বেতমুড়া বলা হতো, আজ কয়েক গ্রাম হাঁটলেও একটি বেতমুড়া বা বেতঝাড় দেখতে পাওয়া যায় না। বেত বনে ছিল ডাহুক পাখির বাস। সকালে দুপুরে রাতে ডাহুক আপন মনে ডেকে যেত মন মাতানো সুরে।
বেত গ্রামের আনাচে-কানাচে ঝোপ-ঝাড়ে অযত্নে বেড়ে উঠলেও তার রয়েছে বাণিজ্যিক কদর। গ্রামের হাটবাজারে বিক্রির পাশাপাশি তা শহরে রপ্তানি হতো। গত কয়েক বছর আগেও জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে হাটের দিন গ্রামের কৃষক শ্রেণির মানুষ বেত বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসতো। একটি ২০-২২ হাত লম্বা বেত আগে বিক্রি হতো ২০ থেকে ২৫ টাকায়। কিন্তু আজ সে বেত ১৫০ টাকা দিলেও পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লৌহজং বাজারের ওড়া বেতের ফার্নিচার ব্যবসায়ী মো. খালেক মিঞা জানান, তিনি পাকিস্তান আমল থেকে এ ব্যবসার সাথে জড়িত। কয়েক বছর আগেও ওড়া বা ধামার চারিদিক মজবুত করে গিঁট দেয়ার জন্য বেত ব্যবহার করা হতো। আজ বেত অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় তার স্থান দখল করেছে প্লাস্টিকের তৈরি দড়ি বা রশি।
খালেকের মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ বাড়ির আশপাশের ঝোপ-ঝাড় কেটে পরিষ্কার করে সেখানে ঘর-বাড়ি তৈরি করছে। এতে যেমন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি প্রয়োজনীয় প্রজাতির লতানো গাছ তেমনি হারাচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। কারণ, আগে যেখানে প্রতি বাড়িতেই বেত ঝাড় দেখতে পাওয়া যেত, সেখানে আজ একটি গ্রাম ঘুরলেও পাঁচটি বেতঝাড় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা ও বাণিজ্যিক প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ গ্রামে এখনো যে সকল ক্ষুদ্র ঝোপ-ঝাড় রয়েছে, সেখানে বেত ঝাড় বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করলে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প প্রাণ ফিরে পাবে বলে অনেকেই মনে করেন।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন