বাংলাদেশের দ্রুত সম্প্রসারণমূলক খাতের মধ্য পোল্ট্রি খাত অন্যতম। এখাতে যথেষ্ট সম্ভাবনায় এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রায়-ই শোনা যায় যে তারা পোল্ট্রি ফার্মে লাভের মুখ দেখতে পারছে না বা অনেক অসুবিধার সন্মুখিন হচ্ছেন। সঠিক উপায়ে পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবস্থাপনা করলে হয়তো এ সমস্যা থাকবে না। কিছু ভুল হয়তো অনেকে করে থাকেন যা আপনাদের সম্ভাবনাকে শুরুতেই ধ্বংস করে দেয়। আসুন পোল্ট্রি ফার্মের কিছু ভুল ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা যাক। তবে নিচের ভুলগুলো সবার নাও হতে পারে। তবে অনেক ফার্মেই সে ভুলগুলো পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো-
১। আলো:
অনেকে প্রথম ১-২ মাস ২৪ ঘণ্টা আলো দেয়া।
ফলাফল:
খাবার বেশি খাবে ও ওজন বেশি হবে, ফ্যাটি হবে। এসব মুরগি গরমে ডিম পাড়ার সময় হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। ১০০০ লেয়ার গ্রোয়িং পিরিয়ডে ২৪ ঘণ্টা বা বেশি আলো দিলে প্রতিদিন প্রায় ১০ কেজি খাবার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেতে পারে, তাহলে যদি ২ মাস ধরি তাহলে ১২ বস্তা খাবার বেশি খেতে পারে। প্রায় ১০,০০০ টাকা বেশি খরচ, পাশাপাশি অন্যান্য
সমস্যা যেমন-ক্যানাবলিজম, ডিম পাড়ার সময় ডিম খায়, যা পরে ঠিক করা যায় না।
২। খাবার:
লেয়ারকে অনেকে ব্রয়লার খাবার দেয়। দিলেও ৭-১০ দিনের বেশি দেয়া ঠিক না। অনেকে ১-৩ মাস পর্যন্ত দেয়। প্রথম থেকেই লেয়ার খাবার দিতে হবে। ব্রয়লার খাবার খরচ বেশি হয়। লেয়ার খাবারের দাম বস্তা ১৯০০-১৭৫০ আর ব্রয়লারের খাবার ২২০০-২০০০ টাকা। মানে বস্তায় ৩০০ টাকা বেশি। হাজারে ১ টন খাওয়ালেও ৬০০০ টাকা বেশি লাগে।
সমস্যা:
ব্রয়লার খাবার দিলে নেক্রোটিক এন্টারাইটিস বেশি হবে। ফ্যাটি হবে। ওজন বেশি হবে। লিভার নষ্ট হবে।
প্রিলেয়ার খাবার:
১৮-২০ সপ্তাহে প্রিলেয়ার খাবার দিতে হয়। অনেকে জানে না তাই দেয় না। যদি না দেয়া হয় তাহলে লেয়ারের হাড়ের ক্যালসিয়াম তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। প্রোডাকশন পিক পিরিয়ড বেশি দিন থাকে না।
কত বার খাবার দিবেন?
প্রথম সপ্তাহে বার বার খাবার দেয়া ভালো, ৮ সপ্তাহের পর দিনে ২ বার খাবার দিতে হবে। শীতকালে ৩ বার দেয়া যায় তবে গরমকালে ২ বার দেয়া ভালো। দুপুরে ২ ঘণ্টা খাবার অফ দিতে হবে যাতে খাবারের গুড়া শেষ হয়ে যায়। অফ দিয়ে খাবার দিলে মুরগি তাড়াতাড়ি খাবার খায়। এতে মুরগির ক্রপ ও ইন্টেস্টাইনেজন বৃদ্ধি ভালো হয়। গুড়া খাবারে ভিটামিন মিনারেল, এমাইনো অ্যাসিড বেশি থাকে। যদি খাবার পাত্রে সব সময় থাকে তাহলে মুরগি বড় বড় দানা বেশি খায়, গুড়া পড়ে থাকে, ফলে মুরগি ছোট বড় হয়।
৩। ওজন:
প্রতি সপ্তাহে মুরগির ওজন নিতে হবে। সে অনুযায়ী খাবার দিতে হবে। ওজন বেশি হবে খাবার বাড়ানোর দরকার নাই। ওজন কম হলে কারণ খুঁজে সমাধান বের করতে হবে। ২০ সপ্তাহের আগে প্রতি সপ্তাহেই ওজন স্ট্যান্ডাড হলে মুরগির হাড়, মাংস, প্রজননতন্ত্র সঠিক হবে যাতে প্রোডাকশন ভালো হয়। পরে ওজন ঠিক করা যায় না। ২০ সপ্তাহের পর ৫০ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৫-২০দিন পর পর ওজন নেয়া ভালো। ৫০ সপ্তাহের পর মাসে একবার। অনেক ফার্মে দেখা যায় মাঝে মাঝে মুরগি মারা যাচ্ছে। ওজন নিয়ে দেখা যায় ওজন ২২০০-২৬০০ ওজনের মুরগি আছে।
৪। লাইট, বাল্ব, নেট, মাকড়সা:
অনেক ফার্মে দেখা যায় বাল্ব, নেট, খাঁচা, মাকড়সা ও ময়লায় ঘিরে আছে।
ফলাফল:
বাতাস চলাচল কম হবে ফলে ভিতরে গ্যাস বেশি হবে। ভিতরের জীবানু বের হতে পারবে না। ফলে রোগ বেশি হবে
ফারমের জন্য যে বালব দেয়া হয়েছে তার ৩০-৪০% আলো মাকড়সা ও ময়লার কারণে শোষণ করে নিচ্ছে। ফলে আলো কমে প্রোডাকশন কমে যায়। সবাই মেডিসিন দিচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
৫। খাবার পাত্র:
অনেকে কাজের লোক দিয়ে কাজ করায় ও কোন হিসেব রাখে না। অনেক ফার্মে ১০০০ লেয়ার মুরগিতে সকালের পাত্রে প্রায় ৫-১৫ কেজি খাবার থাকে। পরের দিন সকালে এই খাবারের উপর খাবার দেয়। এর মানে হলো মুরগি যা খায় তার চেয়ে বেশি খাবার দিচ্ছে। মুরগি প্রতিদিন আগের নষ্ট খাবার খাচ্ছে। যে খাবারে মাইকোটক্সিন থাকে। এইভাবে ফার্ম চলতে থাকে মাসের পর পর মাস।
ফলাফল:
এই বাসী খাবার সব সময় খাওয়ার কারণে মুরগির ইমোনিটি নষ্ট হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, খাবারের ভিটামিন কোন কাজে লাগে না। লিভার নষ্ট হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মুরগি মারা যায়। এন্টিবায়োটিক দিয়েও কাজ হয় না। খরচ বেড়ে যায়। পাত্রে খাবার থাকার কারণে রাত্রে ইঁদুরের পার্টি হয়। ফলে সালমোনেলা, ইকলাই বেড়ে যায়। রোগ বেশি হবার কারণে খরচ বেশি হয়।
সমাধান:
প্রতিদিন রাত্রে খাবার পাত্র তুতে মিশ্রিত নেকড়া দিয়ে মুছে দিতে হবে।
৬। বাচ্চার সেডে পার্টিশন:
পার্টিশন না দিলে মুরগি এক জায়গায় এক পাশে জমা হয় ফলে এসব জায়গার লিটার তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়, পানি ও খাবারের জন্য প্রতিযোগিতা করে ফলে পানি পড়ে লিটার ভিজে যায়, এমোনিয়া গ্যাস হয়, খাবার তাড়াতাড়ি শেষ হয় অন্যদিকে অন্য জায়গায় খাবার শেষ হয় না, খাবার নষ্ট হয়, খাবারের ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়। মুরগি ছোট বড় হয়।
৭। টিকা:
অনেকে টিকা দেয় কিন্তু টিকার সিডিউল ঠিক নাই, দেয়ার পদ্ধতি ঠিক নাই। অনেকে ব্রুস্টার ডোজ দেয় না। টিকা কীভাবে মিক্সার করবে তা জানেন না। যাকে দিয়ে করায় সে সঠিকভাবে দিতে পারে না। ৫০% টিকা কাজ করে না সঠিক সিস্টেম না জানার জন্য।
৮। ফ্লক খাতা:
ফ্লক খাতা ফার্মে নেই বললেই চলে। প্রতিদিন খাবার, পানি, মেডিসিন, টিকা, প্রোডাকশন, মরবিডিটি, মরটাকিটি লিখে রাখতে হবে, তাহলে বুঝা যাবে কোন সমস্যা আছে কিনা। যেমন-যদি খাবার, পানি বা ডিম কমে যায় তাহলে বুঝা যায় ফার্মে সমস্যা আছে। কতদিন পর টিক আবা কৃমিনাশক দিতে হবে তা সহজে বের করা যায়। মাস শেষে লাভ ক্ষতি বের করা যায়।
৯। ওজন নেয়া:
প্রতি সপ্তাহে ওজন নিলে মুরগির ভালো-মন্দ বুঝা যায়, সমস্যা বের করে সমাধান করা যায়। ওজন কম বা বেশি হলে তা সংশোধন করা যায়।
১০। খামারী অনেক সময় নিজের মত করে ভিটামিন বা এন্টিবায়োটিক, পি এইচ বা ক্যালসিয়াম, কফের ওষুধ একটার সাথে আরেকটা মিলিয়ে দেয়, এতে অনেক সমস্যা হয় যদি জানা না থাকে কোনটার সাথে কোনটা দিতে হবে। একটা উদাহরণ দিলাম, টাইলোসিনের সাথে পি এইচ দিলে কোনো ভালো কাজ করবে না।
১১। কাজের লোক:
অনেক সময় কাজের লোক বিভিন্ন ভুল করে থাকে যেমন- মেডিসিন ৩ বেলার জায়গায় দুইবেলা দেয়। ডোজ কম বেশি করে
ফার্ম নোংরা করে রাখে। হিসেব ঠিকমতো করে না। ওজন নিতে বললে অল্প কয়েকটা মুরগির ওজন নিয়ে হিসেব করে যেখানে মিনিমাম ২-৫% মুরগির ওজন নেয়া দরকার। আলো সকাল ৫-৬টায় দেয়ার কথা থাকলে দেয় ৭-৮টায়, রাতে নিভানোর সময়েও কম বেশি করে। রাত্রে খাবার ও পানির পাত্র পরিষ্কার করে না।
১২। ডিম চুরি:
অনেক সময় তারা ডিম চুরি করে, এটা প্রমাণ করা যায় যদি তাদের ছুটিতে পাঠানো হয় তাহলে দেখা যায় প্রোডাকশন ২-৫% এমনকী ১০% ডিম বেড়ে যায়। ঠিকমতো স্প্রে করে না।
১৩। ভ্যাক্সিন ম্যান:
এরা ফার্মে অনেক রোগ ছড়ায়, একই দিনে বিভিন্ন ফার্মে যায় ফলে নতুন ফার্ম আক্রান্ত হয়। তাছাড়া যেভাবে টিকা দেয়ার দরকার সেভাবে দিতে পারে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা জানে না। অনেকে বেশি ফার্মে কাজ করার জন্য তাড়াতাড়ি টিকা দেয়।
পোশাক বদলায় না এবং ভ্যাক্সিন গান ও পরিষ্কার করে না। কিল্ড টিকা নরমাল তাপমাত্রায় আসার পর টিকা দিতে হয় এবং মাঝে মাঝে ঝাকিয়ে নিতে হয়, অনেকে তা করে না। ঠোঁট কাঁটার সময় তারা ব্লেড যতটুকু তাপমাত্রা থাকা দরকার তা থাকে না, পুরান ব্লেড দিয়ে কাজ করে। তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্য ঠোঁট কটারাইজ করে না মানে ব্লেডের সাথে চেপে ধরা যাতে ব্লিডিং না হয়।
আশা রাখি এসব ছোটখাট ব্যাপারগুলো খামারী বন্ধুরা মনে রাখবেন। অনেক ইনভেস্ট করে যদি সামান্য ভুলের কারণে আপনার ফার্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সতর্ক থাকা জরুরি। এটা আপনিও লেখাটা পড়ে বুঝতে পারছেন। সুতরাং টেক কেয়ার।
লেখক: ডা. মো. সোহরাব হুসাইন।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন