দেশে প্রথমবারের ট্রান্সপ্লান্ট (চারা রোপন) ও ডিবলিং (বীজ বপন) পদ্ধতিতে লবণাক্ত ও খরা প্রবণ জমিতে ভুট্টা চাষে সফলতা পেয়েছেন মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।
এ পদ্ধতিতে আগে থেকে উঁচু স্থানে বেডে চারা উৎপাদন করে আমন মৌসুমের শেষে জমিতে কোন চাষ ছাড়াই কর্দমাক্ত অবস্থায় ভুট্টা আবাদ সম্ভব। ইতোমধ্যেই খুলনার লবণাক্ততা গবেষণা কেন্দ্রের জমিতে পরীক্ষামূলক আবাদে সন্তোষজনক ফলাফল এসেছে।
গবেষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে স্থানীয় ভাবে কৃষকরা শুরু করেছেন এ পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত ও সেচের অভাবে পড়ে থাকা উপকূলীয় এলাকার অনাবাদি প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের আওতায় আনার আশা করছেন গবেষকরা। আর সরকারি ভাবে উদ্যোগ নিয়ে এ পদ্ধতি কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় খাদ্য ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, নদী-খাল ভরাট হওয়া আর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে আবাদযোগ্য জমিতে ক্রমাগত লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মৃত্তিকা গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জরিপ মতে, খুলনার মোট ২ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমির মধ্যে লবণাক্ত জমির পরিমাণ এক লাখ নব্বই হাজার হেক্টর। যা মোট আবাদযোগ্য জমির ৮৯ শতাংশ।
এছাড়া লবণ পানির ভয়াবহতার কারনে শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়ায় প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় এলাকায় ৫ লক্ষাধিক হেক্টর জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এসব লবণাক্ত ও খরা প্রবণ জমি আবাদযোগ্য করার লক্ষ্য নিয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ডিবলিং পদ্ধতির পাশাপাশি প্রথমবারের মত ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতিতে কোন রকম চাষাবাদ ছাড়াই কর্দমাক্ত অবস্থায় ভুট্টার পরীক্ষামূলক চাষ করেছেন।
বটিয়াঘাটায় লবণাক্ততা গবেষণা কেন্দ্রের জমিতে ৭২টি প্লটে বারী হাইব্রিড-৭,৯,১২,১৩ ও সুপার ৫৭০ এবং বিএম ৫১৮ জাতের ট্রায়াল আবাদে সফলতাও পেয়েছেন। ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতিতে ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পযর্ন্ত চারা রোপন এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফসল কর্তণ সম্ভব। তাই উপকূলীয় এলাকায় উচ্চ লবণাক্ততা আসার আগেই অনাবাদী ৫ লাখ হেক্টর জমিতে সহিষ্ণু ভুট্টা চাষের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষকরা।
বটিয়াঘাটা উপজেলার দেবীতলা এলাকার কৃষক অংসুমান রায় ও রজত রায় বলেন, মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা কেন্দ্রে দু’টি পদ্ধতিতে ভূট্টো চাষ হচ্ছে জানতে পেরে সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ধান কাটার পর এই সময়টা আমাদের কোন ফসল হয় না। জমি পতিত অবস্থায় থাকে। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষে খরচ ও সেচ কম লাগে। একই সাথে পতিত জমিতেই ভূট্টা চাষ করায় ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই। এতে আমরা লাভবান হবো বলে আশাবাদী।
তারা বলেন, এখানে ১৫ জন কৃষকের ২৫ বিঘা জমিতে ভূট্টা চাষ করা হচ্ছে। পতিত জমিতে ভূট্টা চাষ করায় অনেকেই বলছে তাদের সাথে রাখতে। এতে সফলতা আসবে বলে তারা আশাবাদী।
খুলনা মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, দেশের মোট এলাকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ উপকূলীয় অঞ্চল। এর প্রায় ৩০ ভাগ বিভিন্ন ভাবে লবণাক্ত। এটি উপকূলীয় এলাকার একটি বড় সমস্যা। এখানে পানি এবং মাটি দু’টোতেই লবণ থাকে। যার কারণে কৃষক কোন ফসল ফলাতে পারে না। ফলে আমরা প্রায় তিন বছর ধরে রিসার্স সেন্টারে ভূট্টা নিয়ে গবেষণা করেছি। এতে দেখলাম ডিবলিং ও চারা রোপন পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলক আবাদে সফলতা পাওয়ার পর কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বটিয়াঘাটার ১৫ জন কৃষকের প্রায় ২৫ বিঘা পতিত জমিতে এই দু’টি পদ্ধতিতে ৭টি জাতের ভূট্টার চাষ শুরু করেছি। এতে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। অনেক কৃষক সামনের বছর আমাদের বীজের ব্যবস্থা করার জন্য জানিয়েছে। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা জলাবদ্ধতা, খরা ও লবণ সহনশীল। ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষ দেশে এই প্রথম খুলনায় হয়েছে। এটি এখানকার জন্য উপযোগী। যা দক্ষিণাঞ্চলে কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চাই।
ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস জানান, রূপা, আমন চাষ করার পরে মাটি পতিত থাকে। নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এই জমিতে ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষ করতে পারি। রোপন পদ্ধতি এবং ডিবলিং পদ্ধতিতে ঝড় বৃষ্টির আগেই ফসল তুলতে পারবো এতে সমস্যা হবে না। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষে ব্যয় অনেক কম হয়। পাশাপাশি বোরো ধানের চেয়ে এতে পানি কম লাগে। সবচেয়ে বড় কথা অব্যবহৃত বা পতিত থাকা জমিতে এই ভূট্টা চাষের কারণে ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষ যদি কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে দক্ষিণবঙ্গে বিপ্লব হবে বলে তিনি আশাবাদী।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পংকজ কুমার মজুমদার জানান, ধান কাটার সাথে সাথে কাদার মধ্যেই ভূট্টা রোপন করা যায়। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষ খুবই ভালো। এটি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। এই পদ্ধতিতে ভূট্টা চাষ সম্প্রসারণের চেষ্টা করা হবে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/ মোমিন