মেহেরপুর : জেলায় চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বালাইনাশক বা কীটনাশক। চোরাপথে প্রতিবেশি দেশ থেকে আসা নিষিদ্ধ কীটনাশকও প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বালাইনাশক এক ধরনের ভয়ঙ্কর বিষ। কৃষকরা না বুঝেই বেছে নিয়েছে বালাইনাশককে। ফসলে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়, অবাঞ্ছিত উদ্ভিদ, ছত্রাক ধ্বংস করতে নির্বিচারে ব্যবহার হচ্ছে এ বিষাক্ত বালাইনাশক। জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বালাইনাশক বন্ধের দাবিতে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা লাগাম টানার দাবি জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, কীটনাশক বিক্রি ও ব্যবহারে নেই কোনো তদারকি। ক্ষতিকর বালাইনাশকের লাগাম টানতে না পারলে ঝুঁকি কমবে না জনস্বাস্থ্যের। কীটনাশক ব্যবহারকারী কৃষকদেরও নেই কীটনাশক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ। গ্রাম গঞ্জের মুদি দোকানেও বালাইনাশক বিক্রি হতে দেখা যায়। কৃষকরাও না বুঝে কীটনাশক ব্যবহার করছেন। বছরে অন্তত কয়েক কোটি টাকার কীটনাশক আসছে প্রতিবেশি দেশ থেকে। মারাত্মক ক্ষতিকর যে কীটনাশক দেড় দশকেরও বেশি আগে নিষিদ্ধ করা হয়। এসব নিষিদ্ধ কীটনাশকের মধ্যে আছে ডিডিটি (ডাইক্লোরো-ডাইফেনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন), অলড্রিন, ক্লোডেন ও হেপ্টাক্লোর।
মেহেরপুর জেলায় বৈধ অবৈধ মিলে অন্তত তিনহাজার কীটনাশক বিক্রেতা আছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে কীটনাশক বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৯৩২টি। এরমধ্যে খুচরা বিক্রেতা ৯৫৬ জন। এসব বিক্রেতাদের প্রকলেন, সানটাপ, পুরাটাপ, সায়পার ম্যাথিন নামের কীটনাশকগুলো বিক্রির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ অনুমতি দিয়েছে। এসব কীটনাশক নির্দিষ্ট মাত্রায় সবজি ও ফসলে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। সবজিতে কীটনাশক প্রয়োগের ২১ দিনের মধ্যে সেই সবজি রান্না করে খেলে শরীরে নানা রোগ-বালাই দেখা দেয় বলে চিকিৎসকরা জানান। অথচ কীটনাশক ব্যবহারের পরদিনই কৃষকরা জমি থেকে তুলে বাজারে বিক্রি করেন। এ রকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে।
নাম ‘ওস্তাদ’। এটি একটি কীটনাশক। উপকারী-অপকারী সব পোকা-মাকড়কে নিমিষেই সাবাড় করতে পারে। চোরাইপথে আসা এ কীটনাশক মেহেরপুরের সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। কৃষকরা জমির পোকামাকড় মারতে ওস্তাদের ক্ষতিকর দিক না জেনে অবাধে ক্ষেতে ব্যবহার করে সাময়িক লাভবান হলেও পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ। এ কীটনাশক সবজি, কলা, ধানসহ বিভিন্ন ফসলে অবাধে প্রয়োগের ফলে শুধু ক্ষতিকর কীটপতঙ্গই নয়, বন্ধু পোকা এমনকি ব্যাঙ, সাপসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীও নির্বিচারে নিধন হচ্ছে।
এ ছাড়া খুবই কার্যকর ও ভয়াবহ বিষক্রিয়ার কারণে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে মানব শরীরে নানা ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। ওস্তাদ ছাড়াও থায়োডিন, মিরাকুলান, ক্রিপকর্ড, বাসাথ্রিন, ক্যাপট্যাপ ইত্যাদি কীটনাশক চাহিদার কারণে চোরাই পথে আসছে। এসব কীটনাশক প্রয়োগে কীটপতঙ্গ বিনাশ হলেও উপকারী পোকা ও অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা যায়। বেগুন-জাতীয় সবজিতে এসব ওষুধ দেওয়ার দু-চার দিন পরই ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়।
সদর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের মোজাম্মেল হক ও ঝাউবাড়িয়া গ্রামের হান্নান আলী জানিয়েছেন-তারা ধানিজমিতে থায়োডিন প্রয়োগ করায় তাঁর জমিসহ আশপাশের জমির দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছ, সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়সহ সব ধরনের জলজ প্রাণী মরে-পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। এ বিষ প্রয়োগের কারণে মাটি, পানি ও বায়ু বিষাক্ত-দূষিত হয়ে পড়ে। প্রতিবেশি দেশে মূলত এসব উচ্চমাত্রার বিষ বিভিন্ন বিষাক্ত সাপ, সরীসৃপ, জোঁক ও পিঁপড়া নিধন করতে ব্যবহার হয়।
জেলার কৃষকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে- বর্তমানে ধান, সবজি ও কলায় বিভিন্ন ধরনের নিত্য নতুন পোকা আর রোগব্যাধির আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে প্রচলিত ওষুধ দিয়ে এসব পোকা দমন সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে এসব ওষুধ প্রয়োগ করছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ জানান, দেশে নিষিদ্ধ কীটনাশক ‘ডাইমেক্রন’- অন্য দেশে জঙ্গল ও ড্রেন পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত হয়। অথচ আমাদের এখানে আম, কলা, পেঁপে ইত্যাদি ফলে ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে। এতে এসব ফলের হলুদ রং ধারণ করলেও এ বিষাক্ত কলা খেয়ে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে জটিল রোগে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক ড. মো. আক্তারুজ্জামান জানিয়েছেন, বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষক এখনও কীট, মাকড় ও ছত্রাকনাশক হিসেবে বিষাক্ত বালাইনাশক আশঙ্কাজনক হারে ব্যবহার করছেন। মাঠপর্যায়ে এ রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের তদারকি বেশ দুর্বল।
বিক্রয়কারী কোম্পানি ডিলারদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে এগুলো অবাধে বিক্রি হচ্ছে বলেও তিনি স্বীকার করে আরও বলেন, এখনই এর লাগাম টানার দরকার। নাহলে ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন