আদিত্য বিপ্লব, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: দেশে অধিক উৎপাদনশীল জাতের ধান আসার পর থেকে হাইব্রিড ধান থেকে বীজ সংরক্ষণ করা যায় না। প্রতিবারেই কৃষককে নতুন বীজ কিনে চাষ করতে হয়। ফলে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে আছে কৃষক।
কোম্পানিগুলো কর্তৃক কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বীজের দাম বাড়ানো, ভেজাল ও মানহীন বীজ সরবরাহ করায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় কৃষকদের। এছাড়া একই জমিতে কয়েকবার একই জাতের হাইব্রিড চাষের পর ভালো ফলন হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে জমিতে বেশি দামের নতুন নতুন হাইব্রিড জাতের চাষ করতে হয় কৃষকদের।
কৃষকদের সরকারিভাবে বীজ সরবরাহ করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। বিএডিসি’র তথ্য মতে, চট্টগ্রামে চাহিদার শতকরা ১৭ ভাগ বীজ সরবরাহ করতে পারে এই প্রতিষ্ঠান। আলাদাভাবে ধানের ক্ষেত্রে শতকরা ৪৮ ভাগ বীজ বিএডিসি থেকে আসে। গমের ক্ষেত্রে ভিত্তি বীজ এবং প্রত্যায়িত বীজ শতকরা ৮০ ভাগ বিএডিসি থেকে আসে।
ধানের বাকি বিশাল চাহিদা পূরণ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকরা হাইব্রিড চাষই করছে। ফলে বহুজাতিক কোম্পানির হাতের কব্জায় থেকে চাষ করতে হয় কৃষকদের। হাইব্রিড চাষে বীজ সংরক্ষণ করার কোনো উপায় নেই। এছাড়া কৃষকদের অভিজ্ঞতা বলছে, একটি হাইব্রিড জাত বেশিদিন টিকে না।
এক জমিতে কয়েকবার একটি জাতের ধান চাষ করার পর নতুন হাইব্রিড জাত নিতে হয়। তখনই বাজারের নতুন জাতের বীজ চলে আসে। কৃষকদের ধারণা, কোম্পানিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই এ কাজ করছে, যাতে নতুন জাত এলে নতুনভাবে দাম বাড়ানো যায়।
অধিক উৎপাদনশীল হাইব্রিড ধান চাষের বিশাল চাহিদা থাকলেও মাত্র ২৩ ভাগ সরবরাহ করতে পারে বিএডিসি। বাকি সিংহভাগ বীজ সরবরাহ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। চট্টগ্রামে বহমাত্রিক সবজির ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে বেসরকারি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম এবছর বহুমাত্রিক সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশ সফলতা অর্জন করেছে। সবজির মূল মৌসুমে অন্যান্য সময় বাহির থেকে সবজি আসতো। এবছর বাহির থেকে কোনো সবজি তো আনতেই হয়নি বরং চট্টগ্রাম থেকে সবজি বাইরে পাঠানো হয়েছে। সবজির এই বিশাল চাহিদা পূরণ করে বহুজাতিক কোম্পানির সরবরাহকৃত বীজ।
বিএডিসির বীজ সরবরাহ প্রক্রিয়া ও কৃষকদের সরকারি বীজে অনাগ্রহতার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএডিসি বীজ সরবরাহ করে ডিলারদের মাধ্যমে। ডিলাররা কৃষকের মাঝে বীজ সরবরাহ করে। বিএডিসি থেকে চট্টগ্রামে সাধারণত ধান, গম, ভুট্টার বীজ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে এসব ফসলের উৎপাদন হয় কম। ফলে ডিলারদের প্রায় সময় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বেশি দামে হাইব্রিড জাতের বীজ বিক্রি করেন।
অনেক সময় অতিরিক্ত লাভের আশায় মানহীন মৌসুমি কোম্পানির বীজ কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেয় ডিলাররা। এছাড়া বিএডিসির বীজ সরবরাহ বন্ধ থাকলে বাজারে বীজের মারাত্মক সংকট তৈরি হয়। এই সংকটময় মুহূর্তে বাজারের চাহিদাকে পুঁজি করে মৌসুমী কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে। হঠাৎ বিভিন্ন নামি বেনামি কোম্পানি এসে বাজার দখল করে।
কৃষকদের অভিযোগ, এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সক্রিয় চক্র।
নগরীর সিনেমা প্যালেস সংলগ্ন এলাকায় বীজের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, দোকানগুলোতে বীজের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। কৃষকের চাহিদা বীজের মেটাতে হাজারো বীজ কোম্পানির বীজ নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন দোকানীরা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সময়ে হাইব্রিডের জয়জয়কার। কৃষকের হাতে বীজ নেই-একথা স্বীকার করে তারা বলেন, এখন কৃষকতো কোম্পানির হাতে সম্পূর্ণ বন্দি। কোম্পানি যেভাবে চায়, কৃষকেরও সেভাবে চলা ছাড়া উপায় নেই। এছাড়া বিএডিসির বীজ সরবরাহে নানা জটিলতা ও হয়রানির কারণে ডিলাররা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বাঁশখালীর পুকুরিয়া ইউনিয়নের কৃষক মোহাম্মদ আমিন। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই কৃষিকাজ করেন। পারিবারিকভাবে তাদের কৃষিকাজে বেশ ঐতিহ্যও রয়েছে। আমিন বলেন, আগে তো আমরা কৃষি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতাম। এখন কৃষিক্ষেত্র কৃষকের হাতে নেই। উৎপাদন বেড়েছে সত্য, তবে উৎপাদনের খরচ বেড়েছে অনেকগুণ। সে হারে কৃষকরা পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। বীজ থেকে শুরু করে পানি পর্যন্ত কিনে চাষ করতে হয় এখন। তাছাড়া বীজের ক্ষেত্রে কোম্পানির কাছে আর বিক্রির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট চক্রের কাছে কৃষকরা বন্দি।
বিএডিসি’র চট্টগ্রাম বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আনন্দ চন্দ্র দাস ফার্মসঅ্যান্ডফার্মারকে বলেন, হাইব্রিড চাষাবাদের ফলে উৎপাদন বেড়েছে। তবে হাইব্রিড চাষে বীজ উৎপাদন করা যায় না। ফলে কৃষকরা হাইব্রিড ফসলের বীজ সংরক্ষণ করতে পারছে না। তাছাড়া বিএডিসি হাইব্রিড বীজ কৃষকের কাছে শতকরা ২৩ ভাগ সরবরাহ করতে সক্ষম। বাকী বীজ বিভিন্ন কোম্পানি সরবরাহ করে থাকে। ফলে কৃষকদের কোম্পানিগুলোর প্রতি নির্ভরশীল থাকতে হয়। অনেক সময় ইনব্রিড বীজও কৃষকদের বেশি দামে ক্রয় করতে হয়। একটি বিক্রেতা চক্র বেশি দামে এসব বীজ বিক্রয় করে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আমিনুল হক ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকমকে বলেন, ‘দেশে খাবারের চাহিদা চরমে। এক্ষেত্রে দেশীয় জাতগুলো চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে আপনা আপনি হাইব্রিড বীজ বাজার দখল করেছে।’ বীজের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/ মোমিন