হাঁসের ভাইরাসজনিত রোগের কারণ ও প্রতিকার

3347

ডাক-প্লেগ

ডা. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সাইদুল হক : হাঁসের বহু প্রকার রোগ হয় তবে মুরগির তুলনায় কম হয়। সংক্রামক রোগের মধ্যে প্রধানত ভাইরাসজনিত রোগই বেশি উল্লেখযোগ্য। ভাইরাসজনিত রোগ যেমন ডাক ডাক প্লেগ ও ডাক ভাইরাস হেপাটাইটিস রোগের কারণে এক একটা অঞ্চলের প্রায় সমস্যা হাঁস উজাড় হয়ে যেতে পারে। নিচে এ রোগ দুটি সমন্ধে বিস্তারিত জানানো হল-

১. ডাক প্লেগ রোগ:

এ রোগের অপর নাম ডাক ভাইরাস এন্টারাইটিস। ডাক প্লেগ রোগ হারপেস (Herpes) গ্রুপের এক প্রকার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হাঁসের মারাত্মক প্রকৃতির সংক্রামক রোগ।

এপিডিমিওলজি: পৃথিবীর যে সমস্যা দেশে হাঁস অর্থকরী সম্পদ হিসেবে খামারে পালিত হয়, সম্ভবত সে সব অঞ্চলে এ রোগ রয়েছে। খামারে বহু সংখ্যক হাঁস একেএ প্রতিপালন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটেই এ যাবৎ এ রোগ নিরুপিত হয়েছে।
রোগ সংক্রমণ ও বিস্তার পদ্ধতি:

ডাক প্লেগ রোগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংক্রমিত হয়। প্রত্যক্ষ সংসর্গ মানে অসুস্থ বা বাহক হাঁসের নিকটে অবস্থান। পরোক্ষ সংসর্গ মানে কলুষিত বা দূষিত পরিবেশ যেখানে ভাইরাস অন্য বস্তুতে লেগে থাকে। এ প্রকার পরিবেশে সংবেদনশীল পাখি এলে রোগজীবাণু তাদের দেহে দূষিত পরিবেশ থেকে সংক্রমিত হয়। হাঁস পানিতে বাস করে। সুতরাং খাল-বিল, নদী-নালা ইত্যাদির পানি এ রোগ বিস্তারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পানিতে ভেসে জীবাণু এক স্থান হতে অন্য স্থানে যেতে পারে। সংবেদনশীল পাখির সংখ্যা এবং ঘনত্ব যত বেশি হবে রোগ ততো দ্রুত বিস্তার লাভ করবে, তার স্থায়িত্ব বেশি হবে এবং মৃত্যুর হার ও বৃদ্ধি পাবে। ডিমের মাধ্যমে এ রোগ সংক্রমিত হবার প্রমাণ এখন ও পাওয়া যায়নি। হাট-বাজারে রোগাক্রান্ত হাঁস ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা বা গ্রামে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কীট-পতঙ্গের মাধ্যমেও এ রোগের বিস্তার ঘটে। সব বয়সের হাঁসই প্রায় সমানভাবে আক্রান্ত হয়। উভয় লিঙ্গের পাখিই সমভাবে আক্রান্ত হয়।

রোগ লক্ষণ :
এ রোগের সুপ্তিকাল (রোগজীবাণু দেহে প্রবেশের পর রোগ প্রকাশ পাবার সময়কাল) প্রায় ৩-৭ দিন। ঝাঁকে আকষ্মিকভাবে রোগের আবির্ভাব এবং অধিক সংখ্যক হাঁসের মৃত্যু লক্ষ্য করা যায়। এই মৃত্যুর হার অপরিবর্তিত থাকে। রোগাক্রান্ত হাঁস আলোর প্রতি অধিক সংবেদনশীল হয়। ক্ষুধামান্দ্য থাকে এবং ঘনঘন পানি পান করে। পালক কুঁচকে যায় এবং পাখা ঝুলে পড়ে। মাথা নিচের দিকে ঝুলে থাকে। বহু হাঁসের মাথা, ঘাড় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কাঁপুনি দেখা যায়। নাক থেকে শেষ্মা ঝরে। হাঁস হাটতে পারে না। একই জায়গায় শুয়ে থাকতে চায়। হাঁটতে গেলে পা ঠিকমত ফেলতে পারে না। ডায়রিয়া দেখা দেয়। পাতলা পায়খানা লেজের আশেপাশে লেগে থাকে। ডিমপাড়া হাঁসের ডিম উৎপাদন হ্রাস পায়। মৃত পুরুষ হাঁসের জননাঙ্গ বেরিয়ে আসে। মৃত্যুর হার ৫-১০০% পর্যন্ত হতে পারে।

রোগ নির্ণয়:

রোগের ইতিহাস, উল্লেখযোগ্য উপসর্গসমূহ এবং প্যাথলজিক্যাল পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে প্রাথমিকভাবে এ রোগ সন্দেহ করা যায়। প্রাণিরোগ অনুসন্ধান ল্যাবরেটরিতে মৃত হাঁসের ময়নাতদন্ত ও ভাইরাস সতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে এ রোগ সনাক্ত করা যায়।

 

প্রভেদমূলক পার্থক্য :

এ রোগকে কখনও কখনও ডাক হেপাটাইটিস বলে সন্দেহ হতে পারে তবে এখানে লক্ষণীয় যে ডাক প্লেগ রোগে সব বয়সী হাঁস আক্রান্ত হতে পারে কিন্তু ডাক হেপাটাইটিস রোগে কেবলমাত্র বাচ্চা হাঁস (৩ সপ্তাহের কম বয়সী) আক্রান্ত হয়। ময়নাতদন্ত ও হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরিবর্তন দেখে এ দুইটি রোগ পৃথক করা যায়।

রোগ প্রতিরোধ :

আক্রান্ত হাঁসকে অতি দ্রুত হাঁসের ঝাঁক থেকে সরিয়ে নিয়ে পৃথক স্থানে রাখতে হবে। খামার রোগমুক্ত রাখার জন্য আক্রান্ত স্থানসহ খামারের সর্বত্র প্রতিদিন জীবাণুনাশক (যেমন Glutex GQ1, Virkon S, TH4+ BZ¨vw`) দ্বারা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। খামারে ব্যবহার্য সকল সরঞ্জামাদি প্রতিদিন পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হবে। খামারের জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে।

ভ্যাকসিনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ :

ডাক প্লেগ ভ্যাকসিন দেশে পাওয়া যায়। ডাক প্লেগ রোগ প্রতিরোধকল্পে সুস্থ এবং রোগাক্রান্ত হাঁসের ঝাঁকে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা যায়। ডাইলুয়েন্ট সহযোগে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার পরই প্রতিটি হাঁসকে চামড়ার নীচে অথবা মাংসপেশীর মধ্যে ০.৫ মিলি করে ভ্যাকসিন দিতে হবে।

প্রাথমিক ভ্যাকসিন প্রদান: রোগমুক্ত এলাকায় ৭-১১ সপ্তাহ বয়সের ভবিষ্যতের ব্রিডারদের জন্য ৪ সপ্তাহের ব্যবধানে ২টি ইনজেকশন। রোগাক্রান্ত এলাকায় ঝাঁকে প্রথম রোগ দেখা দেবার পরই সর্ব প্রথম ১০ দিন বয়সের হাঁসের বাচ্চাকে এক মাত্রা (০.৫ মিলি) করে ভ্যাকসিন দিতে হবে।

বুস্টার: প্রতিবার ডিম পাড়ার মৌসুম শুরুর পূর্বে এক মাত্রা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। এই ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি আমদানিকৃত নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কর্মসূচি মোতাবেক যথারীতি ভ্যাকসিন প্রদান করা হলে খামারে ডাক প্লেগ রোগের মড়ক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দেশে প্রস্তুত ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এই কর্মসূচিতে পার্থক্য হয়। ঢাকার মহাখালীতে এল আর আই কর্তৃক দেশীয় (local) স্ট্রেইন ব্যবহারেও ভাল ফল পাওয়া যায়। এ ভ্যাকসিনে ১০০ মাত্রা টিকা থাকে। ভায়ালে পরিশ্রুত পানি মিশিয়ে মিশ্রিত টিকা হাঁসের বুকের মাংসে ১ মিলি করে ইনজেকশন হিসাবে দিতে হয়। ৩ সপ্তাহ বয়সের হাঁসের বাচ্চাকে ১ম টিকা দিতে হয়। ৬ মাস পর্যন্ত এ টিকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষ্মমতা বজায় থাকে। তাই ৬ মাস পর পর এই টিকা দিতে হয়। খামারে রোগ দেখা দিলে সুস্থ হাঁসগুলিকে আলাদা করে এ টিকা দিতে হয়।

ডাক ভাইরাস হেপাটাইটিজ:

এটা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হাসেঁর বাচ্চার অত্যন্ত ক্ষতিকর সংক্রামক রোগ। এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অল্প সময়ে অনেক হাঁসের মৃত্যু ঘটাতে পারে। রোগাক্রান্ত হাঁসের যকৃতে প্রদাহ হয় বলে এ রোগকে হেপাটাইটিস ও বলা হয়। ১৯৪৫ সালে যুত্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম এ রোগ ধরা পড়ে। এরপর কানাডা,ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইতালি, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রাজিল, জাপান, ইসরাইল, থাইল্যান্ড এবং ভারতবর্ষে এটা পাওয়া গেছে।

রোগের কারণ: পিকোরনা ভাইরাস নামক একপ্রকার ভাইরাস দ্বারা এ রোগ সৃষ্ট হয়।

এপিডিমিওলজি: প্রাকৃতিক নিয়মে ১-২ সপ্তাহের বয়সের হাঁস অত্যন্ত সংবেদনশীল। বয়স্ক হাঁসে এ রোগ হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মে মুরগি ও টারকিতে এ রোগ হয় না। এটা অত্যন্ত ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ এবং প্রকৃতিতে সহঅবস্থান হাঁসের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ডিমের মধ্যে বা কীটপতঙ্গ দ্বারা সংক্রমিত হবার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রোগ থেকে সেরে উঠা হাঁসের পায়খানার সাথে প্রায় ৮ সপ্তাহ যাবৎ এ ভাইরাস দেহ হতে বেরিয়ে আসে। আক্রান্তের হার প্রায় ১০০%। মৃত্যু হার ১ সপ্তাহের কম বয়সের বাচ্চাতে প্রায় ৯৫%, ১-৩ সপ্তাহের বাচ্চাতে প্রায় ৫০% এবং ৪-৫ সপ্তাহের বাচ্চাতে অতি অল্প।

রোগের লক্ষণ:

এ রোগ অতি দ্রুত অল্পবয়স্ক হাঁসের বাচ্চার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক বাচ্চা হঠাৎ পড়ে গিয়ে মারা যায়। কিছু বাচ্চা শুয়ে থেকে ঘাড় পিছনের দিকে বাঁকা করে, চোখ বুঁজে পেট ব্যথার জন্য চিৎকার করে এবং পা ঝাপটায়। এভাবে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা গিয়ে থাকে। কিছু কিছু বাচ্চা ঈষৎ সবুজ বর্ণের পাতলা পায়খানা করে।

রোগ নির্ণয়:

এপিডিমিওলজি, রোগ লক্ষ্মণ এবং পোস্টমর্টেম পরির্বতন এ রোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট। তাই এগুলো দেখে এ রোগ সহজে নিরূপণ করা যায়। এছাড়া পরীক্ষাগারে নিউট্রালাইজেশন এবং আগার জেল ডিফিউশন টেস্ট দ্বারা ভাইরাসের পরিচিতি জানা যায়।

চিকিৎসা: এন্টিসিরাম থেরাপি এ রোগে যথেস্ট কার্যকরী। এ ক্ষেত্রে এন্টিসিরাম বা হাইপার ইমিউনাইজড (Hyperimmunized) হাঁস হতে রক্ত নিয়ে আক্রান্ত প্রতিটি হাঁসে ০.৫ মিলি করে ইনজেকশন করলে যথেষ্ট সুফল পাওয়া যায়।

রোগ প্রতিরোধ :

রোগ প্রতিরোধের জন্য জন্মের পর ৪-৫ সপ্তাহ পর্যন্ত হাঁসের বাচ্চাগুলোকে পৃথকভাবে রাখলে রোগের আক্রমণ হতে রক্ষা করা যেতে পারে। এছাড়া অনাক্রম্যতা (Immunity) সৃষ্টির মাধ্যমে ও রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ অনাক্রম্যতা তিন প্রকারে সৃষ্টি করা যায় যেমন-
১) জন্মের ১ দিনের দিন হতে এন্টিসিরাম বা হাইপার ইমিউন (Hyper-immune) রক্ত হাঁসের বাচ্চাদের ইনজেকশন করা যায়। এতে অপ্রতিরোধী ইমিউনিটি (Passive immunity) দ্বারা হাঁসের বাচ্চার রোগ প্রতিহত করতে সক্ষম হবে।
২) ডিমপাড়া হাঁসকে টিকা প্রদান করে তার দেহে ইমিইনিটি সৃষ্টি করা। এত মাতৃদেহ হতে এন্টিবডি ডিমের কুসুমের মধ্য দিয়ে বাচ্চার দেহে প্রবেশ করে তাকে রক্ষা করে।
৩) জন্মের পরই হাঁসের বাচ্চাকে টিকা প্রদান করা।

তথ্যসূএ: ১. Important poultry disease by MSD- Shering plough. ২. মুরগি ও অন্যান্য পাখির রোগতত্ত্ব বাই প্রফেসর আবদুর রহমান। ৩. Poultry science and medicine by Professor Dr M A Samad.

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন