আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ থেকে: সোনালি আঁশের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশে সোনালি আঁশ পাট রপ্তানি করতো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত ছিল পাট কিন্তু এখন তা এক স্বর্ণালি অতীত। পাটের সেই সোনালি ইতিহাস এখন শুধুই স্মৃতি। সারা দেশে উল্লেখযোগ্য হারে প্রতি বছর কমছে পাটের চাষ। সেই ধারাবাহিকতায় উত্তরবঙ্গের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত নওগাঁতেও কমছে পাটের আবাদ।
এই জেলা বর্তমানে ধান ও সবজি এলাকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে উৎপাদিত ধান ও সবজি। ধান ও সবজির পাশপাশি পাটেরও কিছুটা আবাদ এখনোও বর্তমান আছে। তবে উৎপাদনে খরচ ও পরিশ্রম বেশি এবং জাগ (ভিজানো/পঁচানো) দেয়ার জায়গা না থাকায় প্রতি বছর কমছে পাটের আবাদ। পাট চাষে আগ্রহ কমে কৃষকরা এখন সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। তবে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হলে পাটের আবাদ বৃদ্ধি পাবে। কৃষকরা পাটের দাম পেলে আগামীতে পাটের আবাদ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সচেতনরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলায় পাটের আবাদ করা হয়েছে ৬ হাজর ১৫০ হেক্টর উচ্চ ফলনশীল ও-৪,৭২,৯৮,৯৭ এবং কিছু দেশি, মেছতা ও ভারতীয় জাত। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে ৭০ হাজার ২৩৫ বেল (১বেল সমান ৫মণ) পাট। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৩০ হেক্টর এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছিল।
বর্তমানে পাট উৎপাদনে খরচ ও পরিশ্রম বেশি এবং পাট জাগ (পাট পচাঁনো) দেয়ার জায়গা না থাকায় পাট চাষে আগ্রহ কমেছে চাষিদের। ফলে প্রতি বছর কমছে পাটের আবাদ। আগাম বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ায় ফলন যেমন কম হয়েছে, পাটের মানও হতাশাজনক। খরচের তুলনায় দামে তেমন পোসায় না। এতে লোকসানের দুশ্চিন্তা ভর করে চাষিদের মনে। তাই পাটের আবাদ ছেড়ে সবজির দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, প্রতি বিঘাতে পাটের আবাদ করতে হাল চাষ ৬শ টাকা, বীজ ২শ টাকা, সার, ওষধ, নিড়ানি, সেচ ৪ হাজার টাকা, শ্রমিকের খাবার ২ হাজার টাকা, কাটা ও ধোয়া ৮ হাজার টাকা সহ প্রায় ১৪-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। বিঘা প্রতি পাট উৎপাদন হয়ে থাকে ১০-১৪ মণ।
রাণীনগর উপজেলার কাটরাশইন গ্রামের কৃষক দুলাল সরকার বলেন, পাটের আবাদে সবচেয়ে বড় সমস্যা জাগ দেয়ার জায়গা না থাকা এবং পানি। পাট কাটার পর ভিজানোর জন্য যে সময় পানির দরকার তা পাওয়া যায়না। গত বছর এক বিঘা জমিতে আবাদ করেছিলাম। এ সমস্যার কারণে এ বছর আবাদ করিনি। সে জমিমে এখন পটল করেছি। প্রতিদিন পটল তুলে বাজারে বিক্রি করছি। ভাল দাম পাচ্ছি। পাটের মতো ঝামেলা পোহাতে হয় না।
বদলগাছী উপজেলার নাজিরপুর গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, গতবছর দুই বিঘাতে পাটের আবাদ করেছিলাম। এ বছর ১ বিঘা জমিতে পাট লাগিয়েছি। আলু আবাদের পর জমি ফেলে না রেখে ওই জমিতে পাট লাগানো হয়। পাট লাগানো থেকে শুরু করে ঘরে উঠানো পর্যন্ত প্রচুর কষ্ট করতে হয়। কিন্তু সে তুলনায় আমরা মূল্য পাই না। এক দিকে পাটের দাম না পাওয়া, অপরদিকে পাট জাগ দেয়ার জায়গা এবং পানি না থাকায় বিপাকে পড়তে হয়। তাই পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ কমছে। অনেকে জ্বালানির কাজে পাটকাঠি ব্যবহার করতে স্বল্প পরিমাণ পাটের আবাদ করছে।
মান্দা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়। কিন্তু সেই সোনালি আঁশের আবাদ কমে যাচ্ছে। পাট পচনশীল ও জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া পাটের পাতাকে শাক হিসেবেও খাওয়া হয়। পলেথিনের ব্যবহারে দিন দিন পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। অপরদিকে পাটের জিনিসপত্র পরিবেশ বান্ধব। পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার এবং প্রচারণা বাড়াতে হবে। এছাড়া কৃষকরা যদি পাটের ন্যায্য দাম পাই তাহলে আগামীতে পাটের আবাদ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শষ্য) আ. জা. মু. আহসান শহীদ সরকার, শস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত এ জেলা। এক সময় প্রচুর পাটের আবাদ করা হতো। বৈরি আবহাওয়ার কারণে প্রতি বছর কমছে পাটের আবাদ। পাটের আবাদ ছেড়ে কৃষকরা সবজির আবাদের দিকে ঝুঁকছে। আঁশ ছাড়ানোর (পঁচানো) সময় পানি না পাওয়া পাট নিয়ে বিপাকে পড়তে কৃষকদের। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে এবং স্বল্প পানিতে আবাদে উৎসাহিত করার ফলে পাটের আবাদ ছেড়ে কৃষকদের এখন সবজি চাষের দিকে আগ্রহ বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া আউশ ধান চাষেও কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন