বগুড়া থেকে: হানিফ মণ্ডলের বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার রোহদহ গ্রামে। পেশায় দিনমজুর, পাশাপাশি বাড়িতে গরু লালন-পালন করেন। প্রতিবছর কোরবানির ঈদের হাটে সেই গরু বিক্রি করে একসঙ্গে কিছু অর্থ আয় হয়। এবারের বন্যায় হানিফের ঘরের চালা পর্যন্ত পানি। অতি যত্নে পালন করা গরু রাখার জায়গা নেই। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে দুটি গরু প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
হানিফ জানালেন, বন্যার কারণে একে তো রাখার জায়গা নেই, তার ওপর খাবার দিতে না পারায় গরুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল। এ কারণে বাধ্য হয়েই সেগুলো বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। সাইজ অনুসারে এক লাখ টাকার গরুর দাম কমিয়ে ৮০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। এর পরও ক্রেতা নেই। শেষে দালাল ধরে দুই দিন আগে ৬৮ হাজার টাকা দরে দুটি গরু এক লাখ ৩৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। বললেন, ‘আর কয়েকটা দিন পর কোরবানির পশুর হাটে তুলতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যেত।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যার পানিতে বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় পশু রাখার জায়গা না থাকা এবং পশুখাদ্যের অভাব দেখা দেওয়ায় হানিফের মতোই শত শত গৃহস্থ পরিবার তাদের গবাদি পশু নিয়ে সংকটে পড়েছে। এ অবস্থায় বন্যাকবলিত বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট ও সোনাতলা উপজেলার খামারি ও কৃষকরা কোরবানির হাটের জন্য লালন-পালন করা গরু আগেভাগেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সোনাতলা উপজেলার খামারি আনোয়ার হোসেন রাঙ্গা জানান, তাঁর খামারে বেশ কিছু গরু লালন-পালন করা হয়েছে। এগুলোর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে দেশীয় ঘাস, খড়, খইল, খুদ-কুঁড়া। গরুগুলো ক্রেতাদেরও পছন্দ করার মতোই। কিন্তু কোরবানির হাট পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতে পারছেন না। কারণ বন্যার পানিতে গরুর শেড ডুবে গেছে। চেষ্টা করছেন গরুগুলো এখনই বিক্রি করে দেওয়ার। অথচ আর কয়েকটা দিন পর বিক্রি করলে ভালো দাম পেতেন।
সারিয়াকান্দির নারচী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলতাব হোসেন বান্টু তরফদার জানান, চরগোদাগাড়ী গ্রামে ছোট-বড় অন্তত ৩০টি বড় খামার ছিল। সেগুলো এখন বানের পানির নিচে।
ওই গ্রামের মজিদ সরকার নামের এক খামারি আক্ষেপ করে বললেন, ‘‘এখন নিজেদের পেটেই খাবার নেই, গরুরে খাওয়াব কি? গোচারণভূমিগুলোতেও অথই পানি। এ কারণে বাধ্য হয়ে গরু বিক্রি করে দিচ্ছি।’’
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ হাট বগুড়ার মহাস্থানগড় গরুর হাট। সপ্তাহে দুই দিন এই হাট বসে। এর পাশাপাশি ঘোড়াধাপ, সুলতানগঞ্জ হাট, শেরপুর হাট, সাবগ্রাম হাট, পেরী হাট, নামুজাসহ আরো অর্ধশতাধিক স্থানে হাট বসে। এসব হাটে স্থানীয়ভাবে যেমন কোরবানির পশু কেনাবেচা হয়, তেমনি অন্য জেলার জন্যও পশু কেনাবেচা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে কোরবানির পশুর হাট বসতে এখনো বেশ কিছুদিন বাকি। এ অবস্থায় এসব হাটে এখন গরু কম আমদানি হওয়ার কথা। তবে বন্যার কারণে এবার আগেভাগেই এসব হাটে গরু উঠছে। যেকোনোভাবে হোক বিক্রি করে দেওয়ার ইচ্ছা থেকে খামারিদের পক্ষ থেকে দামও চাওয়া হচ্ছে বেশ কম।
বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় প্রচুরসংখ্যক দেশীয় জাতের গরু পালন করা হয়েছে। জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা প্রায় তিন লাখ ৩৫ হাজার। গত বছর কোরবানি দেওয়ার সংখ্যা ছিল সব মিলিয়ে তিন লাখ ২৬ হাজার ৪০৫টি। এ বছর জেলায় দুই লাখ ৯৩ হাজার ৬২টি গরু, দুই হাজার ৪৮টি মহিষ, দেড় লক্ষাধিক ছাগল, সাড়ে ২৬ হাজার ভেড়া মিলে মোট গবাদি পশু পালন করা হয়েছে তিন লাখ ৮৮ হাজার ৮০৮টি।
তিনি জানান, জেলায় বরাবরই চাহিদার তুলনায় বেশি পশু লালন-পালন হয়। বাড়তি পশুগুলো বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। সবচেয়ে বেশি যায় ঢাকায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেটেও এখান থেকে কোরবানির পশু যায়।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য অনুসারে, এবারের বন্যায় বগুড়ায় ১৫টি গবাদি পশু ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২০টি খামার। চারণভূমি নষ্ট হয়েছে তিন হাজার ৬২৫ একর জমির। বন্যায় জেলায় সব মিলে প্রায় এক কোটি ৬৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে খামারিদের।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানান, এই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ৯১টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। এতে সারিয়াকান্দি সদর, চন্দনবাইশা, কামালপুর, বোহাইল, হাটশেরপুর, কাজলা, চালুয়াবাড়ী, কুতুবপুর ও কর্ণিবাড়ী এলাকায় গরুর খামারিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিপাকে পড়ে খামারিরা এখন গবাদি পশুগুলো কোরবানির ঈদের অনেকটা আগেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সূত্র: কেকে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন