হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর অভিনব ‘তুষ-হারিকেন’ পদ্ধতি

1547

হাস

প্রযুক্তি কিংবা উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে নয় কেবল মাত্র তুষ-হারিকেন আর লেপ ব্যবহার করে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা গ্রামে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হচ্ছে। এ পদ্ধতিকে তুষ-হারিকেন পদ্ধতি বলে। দামিহা গ্রামের আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানো শুরু করেন। এ কারণে দামিহা গ্রাম এখন হাঁসের বাচ্চার গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোতে খরচ অনেক কম হওয়ায় দিন দিন এই পদ্ধতিটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে এখন আর এই পদ্ধতিটি শুধু দামিহা গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই।

পাশ্ববর্তী কাছিলাহাটি, রাহেলা গ্রামসহ উপজেলার ১০টি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের ৮০টি হ্যাচরিতে প্রতি মৌসুমে হাঁসের ডিম থেকে প্রায় ২ কোটি বাচ্চা ফোটানো হয়। অনেক শিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত বেকার যুবক তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন স্বাবলম্বী। উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধুমাত্র নিয়মানুবর্তিতাকে পুঁজি করেই যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদন প্রক্রিয়া
তুষ পদ্ধতির একমাত্র তাপ পরিমাপ যন্ত্র থার্মোমিটার ছাড়া আর সবই দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহার করা হয় স্থানীয়ভাবে তৈরী ‘সিলিন্ডার’ নামে পরিচিত বিশেষ পাত্র, ডিম রাখার মাচা এবং উৎপাদিত হাঁসের বাচ্চা রাখার শেড। বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে ওই বিশেষ পাত্র ও মাচা তৈরী করা হয়। এছাড়া প্রয়োজন হয় তুষ, হারিকেন, লেপ, রঙ্গিন কাপড়সহ আনুষাঙ্গিক কিছু উপকরণ।

ডিম উৎপাদনের জন্য ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। তবে, এই তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠানামা করলেও সমস্যা হয় না। ৯শ ডিমের জন্য একটি কাঠের বাক্সের পরিমাপ হল- দৈর্ঘ্য ৫ ফুট, প্রস্থ ৩ ফুট ও উচ্চতা ৩২ ইঞ্চি। উপর দিক খোলা এই বাক্সে দুইটি বাঁশের চটির তৈরি সিলিন্ডার যা দেখতে অনেকটা তেলের ড্রামের মতো। সিলিন্ডারের ব্যাস ১৮ থেকে ১৯ ইঞ্চি এবং উচ্চতা হবে অনধিক ২৭ ইঞ্চি। কাঠের বাক্সে ৫ ইঞ্চি পরিমাণ দেশীয় ধানের মোটা তুষ বিছিয়ে পাশাপাশি সিলিন্ডার দুইটি বসিয়ে দিতে হয়। এর ফলে সিলিন্ডারের বাহির অংশ ও বাক্সের ভিতর অংশে সৃষ্ট ফাঁকা বর্ণিত মোটা তুষ দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হয়।

বাক্স তৈরী হয়ে গেলে উর্বর ডিম বাছাইয়ের পালা। সঠিকভাবে প্রজনন হয়েছে এ রকম মাঝারি সাইজের ডিমকে উর্বর ডিম বলে। ডিম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অধিক বড় এবং একবারেই ছোট ডিম এড়িয়ে যাওয়া ভাল। ডিম সংগ্রহের পর জীবাণুনাশক দিয়ে সেগুলো ধুয়ে বাছাই করে রোদে শুকানো হয়। এরপর ডিমগুলো রঙ্গিন কাপড়ের থলেতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভরে সিলিন্ডারের ভেতরে রাখা হয়। পরিস্কার করা ডিম রঙ্গিন কাপড়ের পুটলিতে ২৫ থেকে ৫০ টি ভরে মুঠি বাঁধতে হয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন ডিম গুলো যাতে পুটলির মুঠি ধরে নিচ থেকে উপরে চাপ দিলে ভিতরে রাখা ডিম গুলো সহজেই ঘুরতে পারে।

এভাবে একই মাপের একটি বক্সের একটি সিলিন্ডারে প্রায় ৯শ ডিম সাজিয়ে অপর সিলিন্ডারে কেরোসিনের চালিত একটি হ্যারিকেন রাখতে হয় এবং ডিম বসানোর পরে পাটের মোটা চট দিয়ে ঢেকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ডিম গুলো শুরু থেকে ১৬ দিন পর্যন্ত প্রতি ৫ থেকে ৬ বার উপরের ডিম নিচে আর নিচের ডিম উপরে রেখে উল্টেপাল্টে দিতে হবে আর হ্যারিকেনের সিলিন্ডার পরিবর্তন করতে হবে। থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হয়। তাপমাত্রা বেশী হলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এছাড়াও সিলিন্ডারের মুখ খোলা রেখে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

১৬ দিনের পর ডিম গুলো কাঠের ওপরে ৫ ইঞ্চি পরিমাণের তুষের বিছানা বা লিটার তৈরী করে একে একে ডিম গুলো পাশাপাশি বসাতে হবে এবং মোটা পাঁটের চট দিয়ে ঢেকে দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তাপমাত্রা যেন পূর্বের মতোই হয়। ডিমে বাচ্চা আসার কারণে ডিমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়। এ সময় বিছানায় থাকা ডিম গুলো ২ঘন্টা পর পর নাড়াচাড়া করে দিতে হয় যাতে করে বাচ্চা খোলস ভেঙ্গে বেরুতে সহজ হয়। প্রতি ক্ষেত্রেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে নাড়াঁচাড়া করতে গিয়ে ডিম ফেঁটে বা ভেঙ্গে না যায়। এভাবে পরিচর্যা করলে ২৬ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে পূর্ণ বাচ্চা পাওয়া যায়।

 

ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ